পাঁচ রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত অর্থবছর। চাহিদা না থাকার পরও কেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সাথে মন্ত্রনালয়ের দর কষাকষির ফলে এখনও সমঝোতায় আসতে পারেনি দুই পক্ষ। এতে করে যেমন কোম্পানিগুলোর ভবিষৎ অনিশ্চয়তায় রয়েছে, ঠিক একইভাবে অনিশ্চয়তায় রয়েছে লাখো বিনিয়োগকারীর ভাগ্যও। কোম্পানিগুলোর ৪৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এসব কেন্দ্রের জন্য ট্যারিফ বা মূল্যহার নিয়ে সমঝোতা না হলেও পেরিয়ে গেছে পাঁচ মাস, এখনও কেন্দ্রগুলোর চুক্তি নবায়ন করা যায়নি। কবে নাগাদ চুক্তি নবায়ন হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই।
আর চুক্তির এমন অনিশ্চয়তার ফলে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করা সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সরকার কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি নবায়ন করবে এমন খবরে শেয়ারবাজারে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের চাহিদা বেড়ে যায়। দর বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কিন্তু কোম্পানি এবং মন্ত্রনালয়ের এমন দর কষাকষির কারণে কমতে শুরু করেছে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর। এতে করে বড় আকারের ক্ষতির মূখে পড়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রস্তাবিত কেন্দ্রগুলো হলো ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার, ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট (সাবেক আইইএল কনসর্টিয়াম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস), ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস (ওরিয়ন গ্রুপ), ৪০ মেগাওয়াট সক্ষমতার খুলনা পাওয়ার কোম্পানি (কেপিসিএল-৩) নোয়াপাড়া ও ১১৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেপিসিএল ইউনিট-২।
বিদ্যুৎ বিভাগ চাইছে, নো পারচেজ, নো পেমেন্ট; অর্থাৎ বিদ্যুৎ কেনা না হলে কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করা হবে না এমন শর্তে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করতে। পাশাপাশি কোনো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট থাকবে না, বা বিদ্যুৎ কেনার কোনো গ্যারান্টিও থাকবে না। কিন্তু কোম্পানিগুলো চাইছে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনার গ্যারান্টি। এই নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছে উভয় পক্ষ। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রনালয় এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কোনো ধরনের ঋণ বা দায় দেনা না থাকার কারণে কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়া যাবে না। আর চাহিদা না থাকায় নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ কেনার গ্যারান্টি দেয়ারও প্রশ্ন আসে না। শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় দেয়া যাবে। আর মালিকদের সর্বনিন্ম মুনাফা দেয়া হবে। ইউনিটপ্রতি তা ৫-১০ পয়সা হতে পারে। তবে সেটা নির্ধারিত নয়, বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণের ওপর তা নির্ভর করবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেনার কোনো গ্যারান্টি থাকবে না এমন শর্তে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এতে বিদ্যুৎ কেনার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। যতটুকু বিদ্যুৎ কেনা হবে, শুধু সেটুকুর দাম দেয়া হবে। আগে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনার শর্ত ছিল। আর সরকার কোনো বিদ্যুৎ না কিনলে অর্থাৎ কেন্দ্র অলসভাবে বসে থাকলেও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে পরিশোধ করতে হতো, যা ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’নামে পরিচিত।
উল্লেখ্য, দর প্রক্রিয়া ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্র পাঁচটি বিশেষ বিধানের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছিল, যেগুলো উৎপাদনে আসে ২০১১ সালে। ২০১৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করা হয়। গত অর্থবছর সবকটির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে কেপিসিএল ও সামিট পাওয়ার। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে আরও পাঁচ বছর সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। তবে সরকার দুই বছরের জন্য নবায়নে সম্মত হয়েছে। যদিও আগামী মার্চের আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে না।
এই প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়তে বাড়তে ৩০ ডলার/এমএমবিটিইউ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এখন দাম হ্রাস পাচ্ছে। আগামীতে আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি এলএনজির দাম আরও কমে ১৫ ডলারে নেমে আসে, তাহলে আর তেলচালিত কেন্দ্র দরকার হবে না। বরং গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম পড়বে। আর যদি দাম খুব একটা না কমে তাহলে ফার্নেস অয়েলেই সাশ্রয় হবে। তাই চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে জ্বালানির দাম একটা ফ্যাক্টর হয়ে আছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী মার্চে অর্থাৎ গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরুতে চাহিদা বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে। এলএনজি পাওয়া গেলে সে সময় গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন শুরু করা হবে। তখন ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র আর দরকার হবে না। তবে গ্যাস পাওয়া না গেলে চুক্তি নবায়ন করতে হবে। সেই সময়ের আগে চুক্তি নবায়ন নাও হতে পারে।