দেশের ৬২টি ব্যাংকের ১০টি পূর্ণাঙ্গভাবে এবং ৩৪টি নানা উপায়ে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। করোনা সংকটের বছরেও পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে মোট আমানতের ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
অনিয়ম, অব্যবস্থা ও খেলাপি ঋণ নিয়ে দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় চলছে নাভিশ্বাস। সরকারের কাছ থেকে নানামুখী সুবিধা নিয়েও হচ্ছে না অবস্থার উত্তরণ। এর মধ্যেও ভালো ব্যবসা করছে ইসলামি ধারার ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, “বাজার প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জে টিকে থাকতে প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে যাচ্ছে। কারণ, ইসলামি ব্যাংকগুলোতে স্বেচ্ছায় অনেক আমানত আসে। ধর্মপ্রাণ অনেকে এ ধারার ব্যাংকে লেনেদেনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ জন্য আমানতকারীরা দর-কষাকষি করেন না। তাদের বেশির ভাগই একটি ব্যাংকে আমানত রেখেই খুশি থাকেন। তবে ঋণ বিতরণে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে পার্থক্য কিছু নেই।”
তিনি বলেন, “ইসলামি ব্যাংকগুলোর কস্ট অব ফান্ড কম। আবার রেমিট্যান্স সংগ্রহ হয় বেশি। এসব কারণে ইসালামি ব্যাংকিংয়ে ঝোঁক বাড়ছে।”
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ইসলামি ধারার ব্যাংকিংয়ে এখনও অনেক দুর্বলতা রয়েছে। স্বতন্ত্র ইসলামি ব্যাংকিং নীতিমালা দরকার, যা এখনও হয়নি। প্রচলিত ধারার ব্যাংক ও ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাজের মধ্যে শব্দগত পার্থক্য ছাড়া পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত পাথর্ক্য তেমন নেই। নীতিমালা করা হলে ইসলামি ব্যাংকিং আরও প্রসারিত হবে। পাশাপাশি ব্যাংক ব্যবস্থার মন্দ ঋণ কমে আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অর্থায়ন সহজ হবে।
১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে দেশে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকিংব্যবস্থা চালু হয়। এরপর নতুন পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক যেমন এসেছে, তেমনি প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক ইসলামি ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডো চালু করেছে। আমানত সংগ্রহ, শিল্প, ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ, প্রবাসী আয় সংগ্রহে মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
দেশে কতটি ইসলামি ব্যাংক:
দেশে বর্তমানে ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে পুরোদমে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে ১০টি ব্যাংক। তবে স্ট্যান্ডার্ড ও গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক (সাবেক এআরবি গ্লোবাল) জানুয়ারি থেকে পুরোদমে ইসলামি ব্যাংকিং চালু করায় এ দুটি ব্যাংকের বিস্তারিত এ প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়নি।
আগের আটটি ব্যাংক হলো : ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, শাহজালাল ইসলামী, ইউনিয়ন, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড।
এসব ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১ হাজার ৩১১টি। এ ছাড়া প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৯টি ব্যাংকের ১৯টি ইসলামি ব্যাংকিং শাখা রয়েছে। ১৪ বাণিজ্যিক ব্যাংকের রয়েছে ১৯৮ ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো।
সারা দেশে মোট ১ হাজার ৫২৮টি শাখায় ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী লেনদেন হয়। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের শাখা ১ হাজার ৩১১টি।
ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী ব্যাংকিং পরিচালনায় ব্যাংকগুলোতে ৩৮ হাজার ৭৮৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
আমানতের পরিমাণ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক হিসাবে দেখা যায়, মহামারির বছরে ইসলামি ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে ৪৬ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতে মোট আমানত ১২ লাখ ৯০ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর (প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংকে ইসলামি ব্যাংকিং শাখা, উইন্ডোসহ) আমানত রয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এ অঙ্ক পুরো আমানতের ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
২০১৯ সালে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর আমানত ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার ২২৭ কোটি টাকা।
আমানত সংগ্রহের দিক থেকে সবার শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ৩৬ দশমিক ১৩ শতাংশ সংগ্রহ করেছে ব্যাংকটি।
এর পরই রয়েছে ক্রমান্বয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৩ দশমিক ১১, এক্সিম ১২ দশমিক ২৫, আল-আরাফাহ ১০ দশমিক ৬১, সোশ্যাল ইসলামী ৯ দশমিক ১৫, শাহজালাল ইসলামী ৬ দশমিক ৬৯, ইউনিয়ন ব্যাংক ৫ দশমিক ২৮ ও আইসিবি ইসলামিক দশমিক ৩৮ শতাংশ।
ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের আমানত রাখার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মুদারাবা আমানত সবচেয়ে বেশি ৪৭ দশমিক ০৭ শতাংশ।
এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংকিং শাখাগুলোতে মোট আমানতের ৩ দশমিক ১১ শতাংশ এবং ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডোগুলোতে ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ আমানত রয়েছে।
বিনিয়োগ চিত্র:
ডিসেম্বর শেষে দেশে ব্যবসারত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো মোট ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ বা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ইসলামি ধারার আট ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
২০১৯ সালের তুলনায় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। ওই বছর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ ঋণ বিতরণ করে শীর্ষে আছে ইসলামী ব্যাংক।
এর পরই রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৪ দশমিক ০৯, এক্সিম ১৩ দশমিক ০৭, আল-আরাফাহ ১০ দশমিক ৫৩, সোশ্যাল ইসলামী ১০ দশমিক ০৮, শাহজালাল ইসলামী ৬ দশমিক ৬৮, ইউনিয়ন ব্যাংক ৫ দশমিক ৬৬ ও আইসিবি ইসলামিক দশমিক ২৯ শতাংশ।
ইসলামি ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে “বাই মুরাবাহ” সবচেয়ে প্রচলিত। মোট বিনিয়োগের প্রায় ৪৫ শতাংশ করা হয়েছে এ পদ্ধতিতে। এর পর রয়েছে “বাই মুয়াজ্জল”। এ ব্যবস্থায় মোট বিনিয়োগের ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ করা হয়েছে।
বাকি বিনিয়োগ করা হয়েছে বাই সালাম, ইজারা অ্যান্ড ইজারা, বাই ইসতিসনা, মুসারাকাসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে।
ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ব্যবসা ও বাণিজ্য খাতে ৪৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর পরে দ্বিতীয় অবস্থানে শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বৃহত্তর ও সেবা বাণিজ্যে ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এ ছাড়া অবকাঠামোতে ৯ দশমিক ০৫ শতাংশ, কটেজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে করেছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ভোক্তা খাতে ২ দশমিক ৮৯, কৃষিতে ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যোগাযোগ খাতে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ, অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানকি ঋণ ১ দশমিক ৩৯ এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে দশমিক ১৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে ইসলামি ব্যাংকগুলো।
এ ধারার ব্যাংকগুলো আধুনিক ধারার সব ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ইসলামি ব্যাংকগুলোর জন্য সুকুক বন্ড চালু করেছে। সুদবাহী বিনিয়োগ বন্ডে ইসলামি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারে না বলে নতুন ধরনের এ বন্ড চালু করা হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনার নতুন এ মাধ্যমে সরকার চাইলে ইসলামি ব্যাংকগুলো থেকেও মূলধন নিতে পারবে।
তারল্য প্রবাহ:
ব্যাংকিং খাতে এখন মোট তারল্য ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর হাতে অলস টাকার পরিমাণ ২৯ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৯ সালে শেষে এই অঙ্কটা ছিল ৯ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা।
রেমিট্যান্স:
দেশের মোট প্রবাসী আয়ের ৪০ দশমিক ৫১ শতাংশের অধিক এসব ব্যাংকের মাধ্যমে আসে। অবশ্য এর মধ্যে কেবল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মাধ্যমেই আসে প্রায় ৭৫ শতাংশ প্রবাসী আয়। ডিসেম্বর শেষে এ ধারার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ২১ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছে।