মোবাইল অপারেটরদের জন্য ২৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বিক্রির নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। তরঙ্গ নিলামে ১৮০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গের সব ব্লক এবং ২১০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গের তিনটি ব্লক বিক্রি হয়ে গেলেও একই মেগাহার্টজে শেষ একটি ব্লকে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনতে নিলামযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশের শীর্ষ দুই অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি আজিয়াটা। শেষ পর্যন্ত দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরে শেষ ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনে নেয় শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। শীর্ষস্থান ধরে রাখতে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের জন্য ভিত্তিমূল্যের চেয়ে ৮৩৭ কোটি টাকারও বেশি গুনতে হয়েছে গ্রামীণফোনকে।

গতকাল বেলা ১১টায় ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ১৮০০ মেগাহার্টজ ও ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে মোট ২৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়। গতকাল নিলামে সব তরঙ্গ বিক্রি হয়ে যায়। তরঙ্গ বিক্রির মাধ্যমে সরকার ৭ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা আয় করেছে। তরঙ্গ বিক্রির ক্ষেত্রে এটিই সরকারের সর্বোচ্চ আয়। এর আগে থ্রি-জির নিলামে তরঙ্গ বিক্রি থেকে সরকারের আয় হয় ৫২৫ মিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। গতকাল নিলামে অংশ নিলেও কোনো তরঙ্গ কেনেনি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি টেলিটক।

গতকাল নিলাম থেকে গ্রামীণফোন ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড হতে প্রতি মেগাহার্টজ ৩১ মিলিয়ন ডলার মূল্যে শূন্য দশমিক ৪ মেগাহার্টজ এবং ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড হতে প্রতি মেগাহার্টজ ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কেনে। তবে শেষ ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ ভিত্তিমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দরে কিনতে হয়েছে। এই ব্লকের নিলাম প্রক্রিয়ার শুরুতে ডাক থেকে সরে আসে বাংলালিংক। পরে বিকেল ৪টার দিকে টেলিটকও সরে আসে। এই তরঙ্গ কিনতে গ্রামীণফোনের সঙ্গে রবি আজিয়াটাও পাল্লা দিয়ে নিলামযুদ্ধে অংশ নেয়। রবি ও গ্রামীণফোনের নিলামযুদ্ধের কারণে ভিত্তিমূল্য ২৭ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়তে বাড়তে ৪৫ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। তবে প্রায় আট ঘণ্টার নিলামযুদ্ধ শেষে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গ ৪৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৯৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা দরে কিনে নেয় গ্রামীণফোন। শুধু এই ব্লকের ৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কিনতে গ্রামীণফোনকে ১ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।

গতকাল নিলামের শুরুতে ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ মোট পাঁচটি ব্লকে নিলাম প্রক্রিয়া হয়। এর মধ্যে দুটি ব্লক দশমিক ৪৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গের এবং দুটি ব্লক ২ দশমিক ২ মেগাহার্টজ তরঙ্গের। প্রতিটি ব্লকের ভিত্তিমূল্য ছিল ৩১ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২ দশমিক ২ মেগাহার্টজ তরঙ্গের দুটি ব্লক নিয়ে মোট ৪ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ নেয় বাংলালিংক। রবি ২ দশমিক ২ মেগাহার্টজের একটি এবং দশমিক ৪৪ মেগাহার্টজের একটি নিয়ে মোট ২ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ তরঙ্গ নেয়। আর গ্রামীণফোন নেয় একটি ব্লকে দশমিক ৪৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। নিলামে ভিত্তিমূল্যর ওপর কোনো দাম না ওঠায় সেই দামেই অপারেটররা তরঙ্গ পেয়ে যায়। মোটামুটি এক ঘণ্টার মধ্যে প্রথম ধাপের নিলাম শেষ হয়। তাতে ৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ বিক্রি করে সরকারের আয় হয় ২২৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার।

২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ২০ মেগাহার্টজ ব্যবহারযোগ্য তরঙ্গ ৫ মেগাহার্টজ করে মোট চারটি ব্লকে বিক্রির জন্য নিলাম শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। প্রতিটি ব্লকের ভিত্তিমূল্য ছিল ২৭ মিলিয়ন ডলার। বেলা দেড়টার দিকে প্রথম ব্লকে টেলিটক বাদে বাকি তিন অপারেটর ২৭ মিলিয়ন ডলার থেকে ডাক শুরু করে। টেলিটক সরে যাওয়ার পর ২৯ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত দরে থাকে তিন কোম্পানি। এরপর কেউ আর ডাক না বাড়ালে নিয়ম অনুসারে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক ৫ মেগাহার্টজ করে তরঙ্গ পায়। ১৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গ সেখানে বিক্রি হয়ে যায়।

৫ মেগাহার্টজ তরঙ্গের বাকি একটি ব্লকের নিলামে ২৭ মিলিয়ন ডলার থেকে ডাক শুরু হলে প্রথমেই বাংলালিংক নিলাম থেকে সরে আসে। এরপর প্রতি ডাকে দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার করে দর বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে ৩০ মিলিয়ন ডলারে গিয়ে থামার পর বেলা পৌনে ৩টায় বিরতি দেওয়া হয়।

বিকেল পৌনে ৪টার দিকে আবার নিলাম প্রক্রিয়া শুরু হলে ৩০ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে দাম হাঁকা শুরু হয়। ৩০ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলারে দাম উঠলে ১৬তম রাউন্ডে সরে দাঁড়ায় টেলিটক। এ নিলামের পর ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটক ছাড়া অন্য তিন মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রত্যেকের ২০ মেগাহার্টজ করে তরঙ্গ থাকবে। যেখানে টেলিটকের রয়েছে মাত্র ১০ মেগাহার্টজ।

এবারের নিলামে ভিত্তিমূল্য ধরা হয় সরকারের পূর্বানুমোদনপূর্বক ২০১৮ সালের নিলামের বিক্রয় মূল্য অনুযায়ী অর্থাৎ ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের ১ মেগাহার্জ তরঙ্গ মূল্য ১৫ বছরের জন্য ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হারে এবং ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডের ১ মেগাহার্জ তরঙ্গ মূল্য ১৫ বছরের জন্য ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হারে। ২০১৮ সালের অকশনে নিলামকৃত তরঙ্গ অপারেটরের চাহিদা অনুযায়ী ২-জি বা ৩-জি অথবা ৪-জি লাইসেন্সের মেয়াদে তরঙ্গ বরাদ্দ গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছিল। তরঙ্গ বরাদ্দপত্র জারির তারিখ থেকে প্রতি এক বছর অন্তর বাৎসরিক ১৫ শতাংশ হারে বাকি ৭৫ শতাংশ চার্জ পাঁচটি কিস্তিতে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে গ্রামীণফোনের বর্তমান তরঙ্গ ১৯ দশমিক ৬ মেগাহার্জ হতে ২০ মেগাহার্জে এবং ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে গ্রামীণফোনের বর্তমান তরঙ্গ ১০ মেগাহার্জ হতে ২০ মেগাহার্জে উন্নীত হলো। ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে রবির বর্তমান তরঙ্গ ১৭ দশমিক ৪ মেগাহার্জ হতে ২০ মেগাহার্জে এবং ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে রবির বর্তমান তরঙ্গ ১০ মেগাহার্জ হতে ১৫ মেগাহার্জে উন্নীত হবে। ১৮০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে বাংলালিংকের বর্তমান তরঙ্গ ১৫ দশমিক ৬ মেগাহার্জ হতে ২০ মেগাহার্জে এবং ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে বাংলালিংকের বর্তমান তরঙ্গ ১০ মেগাহার্জ হতে ১৫ মেগাহার্জে উন্নীত হলো। টেলিটক ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে প্রতিযোগিতামূলক নিলামে অংশগ্রহণ করেও শেষ পর্যন্ত কোনো তরঙ্গ কিনতে পারেনি। সুতরাং ২১০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে টেলিটকের বর্তমান তরঙ্গ ১০ মেগাহার্জ ব্যবহার করেই তাদের সেবা প্রদান কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ নিলামে ডাক ও টেলিযোগাযাগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারসহ অপারেটরদের নির্বাহী কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদুল আলম নিলাম পরিচালনা করেন।