শতভাগের বেশি বোনাস শেয়ার ঘোষণার পর উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে যেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা বিপাকে, তার একটি জেমিনি সি ফুড।
১৯৮৫ সালে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি ২০১৭ ও ২০১৮ সালে দুই বছরের মধ্যে শেয়ার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন গুণ। এত বেশি হারে বোনাস শেয়ার ঘোষণার কারণ হিসেবে ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা জানায় তারা।
কিন্তু ব্যবসা বাড়েনি, উলটো সংকুচিত হয়েছে, আর লোকসানে ডুবতে থাকা কোম্পানিটি এখন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে সংশয়।
কোম্পানিটি প্রথম যে বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বোনাস শেয়ার দেয়, সেই ২০১৬-২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি আয় ছিল প্রায় ২১ টাকার। ওই বছর তারা প্রতি দুটি শেয়ারের বিপরীতে একটি করে বোনাস শেয়ার দেয়।
পরের বছর শেয়ারপ্রতি আয় ৩৫ শতাংশের বেশি কমে ১৩ টাকা ৬ পয়সা হলেও বোনাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় কোম্পানিটি। সে বছর ১২৫ শতাংশ অর্থাৎ চারটি শেয়ারের বিপরীতে পাঁচটি বোনাস শেয়ার দেয় তারা।
অর্থাৎ, যার ২০০টি শেয়ার ছিল, দুই বছরের মধ্যে তার শেয়ারসংখ্যা বেড়ে ৬৭৫টি হয়ে যায়।
পরের দুই বছরও যথাক্রমে ১৫ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় কোম্পানিটি। আর যারা আরও দুই বছর শেয়ার ধরে রেখেছেন, তাদের শেয়ারসংখ্যা বেড়ে হয় ৮৫৩টি।
চার গুণেরও বেশি শেয়ার বেড়ে যাওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি তো নেই-ই, উলটো কখনও পুঁজি ফিরে পাওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নিয়েই চলতে হচ্ছে তাদের।
২০২০ সালে লোকসানের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি তারা।
২০১৭ সালে যারা ১ হাজার ২২৫ টাকায় শেয়ার কিনেছেন, পরের তিন বছর বোনাস শেয়ার সমন্বয়ের পর দাম পড়ে ২৮৬ টাকা ৯০ পয়সা।
এখন কোম্পানির শেয়ারের দাম ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সা।
লোকসানি এই কোম্পানির শেয়ারমূল্যও ধরে রাখা হয়েছে কৃত্রিমভাবে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে এর নিচে নামতে পারছে না, তবে এই দামে শেয়ার কেনার মানুষ নেই বললেই চলে।
গত ১৮ জানুয়ারির পর এক দিনই বলার মতো লেনদেন হয়েছে কোম্পানিটির। কোনো কোনো দিন কোনো শেয়ারই হাতবদল হয়নি।
যা বলছেন কোম্পানি সচিব
কোম্পানিটি চিংড়ি রপ্তানি করে। বিপুল পরিমাণ বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর পর লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানি সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যে উদ্দেশ্যে বোনাস শেয়ার দিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেটি কার্যত বাস্তবায়ন হয়নি। চিংড়ির যে চাহিদা ছিল সে অনুযায়ী রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পণ্য শতভাগ রপ্তানি হয়। করোনা মহামরিতে বিশ্ববাজার বন্ধ থাকায় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হওয়ায় ব্যবসা ফিরে পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী নজরুল ইসলাম। বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারগুলো চালু হচ্ছে সেহেতু কিছুটা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আমরা চিংড়ির সঙ্গে অন্যান্য সি ফিশ রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছি। সেগুলো জাপান ও ইউরোপের মার্কেটে রপ্তানির জন্য কাজও চলছে। একই সঙ্গে আমাদের পরিচালনা পর্ষদও কোম্পানিকে আরও ভালো করার বিষয়ে আন্তরিক।’
উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন
স্বল্প মুলধনি কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে শেয়ারসংখ্যা বাড়ানোর পেছনে মালিকপক্ষের অন্য উদ্দেশ্য থাকে বলে অভিযোগ আছে।
বেশি বোনাস দেয়ার খবর ছড়িয়ে শেয়ারের দাম বাড়নো হয়। কারণ, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বেশি শেয়ার মানেই বেশি মুনাফা, এই ধরনের একটা ধারণা আছে। আর দাম যখন ওপরে উঠে, তখন উদ্যোক্তা পরিচালকরা ঘোষণা দিয়ে বা না দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেন।
ফ্যামিলিটেক্সের ক্ষেত্রে ঘোষণা না দিয়ে শেয়ার বেচে দেয়ার এই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘যেসব কোম্পানি বড় অঙ্কের বোনাস প্রদান করে সেসব কোম্পানিতি মূলত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হয় বেশি। বিনিয়োগকারীরা মনে করে সমন্বয়ের পর দর বাড়লে তারা লাভবান হবেন। কিন্তু যখন দেখা যায় সেই শেয়ার আর বিক্রি করা যাচ্ছে না তখনই সমস্যা তৈরি হয়।
‘এ জন্য কোম্পানির কাছে টাকা থাকলেও সেটির বিপরীতে বড় অঙ্কের বোনাস দেয়ার প্রবণতা বন্ধে উদ্যোগ নিতে হবে।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘বোনাস শেয়ার দেবে যখন কোম্পানির হাতে টাকা থাকবে এবং তার উদ্দেশ্যে থাকবে কোম্পানি সম্প্রাসারণ। কিন্ত দেশীয় কোম্পানিগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বোনাস দেয় ক্যাটাগরির ধরে রাখতে। কিন্ত বিদেশি কোম্পানিগুলো বোনাস দেয়ার পরপরই তারা কোম্পানি সম্প্রসারণের খবর প্রকাশ করে। ফলে তাদের শেয়ারে দরে কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু দেশি কোম্পানিগুলো আসলে কী উদ্দেশ্যে মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার দেয়, সেটি কখনও স্পষ্ট নয়।’
এরই রকম অভিজ্ঞতা আরও
গত এক দশকে যেসব কোম্পানি মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন হঠাৎ করে বাড়িয়েছে, তার সিংহভাগের পরিণতিই জেমিনি সি ফুডের মতোই।
স্টাইলক্রাফট তিন বছরের ব্যবধানে শেয়ারসংখ্যা ২৩ গুণ করার পর ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা বলে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত তিন বছরে যথাক্রমে ৮০, ৪১০ ও ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় কোম্পানিটি।
কিন্তু কোম্পানির আয় কমতে কমতে এখন লোকসানিতে পরিণত হয়েছে স্টাইলক্রাফট।
একই অবস্থা মুন্নু অ্যাগ্রোর। কোম্পানির নাম আগে ছিল মুন্নু স্টাফলার। পরিশোধিত মূলধন প্রায় ছয় গুণ বাড়িয়ে কোম্পানির নাম ও ব্যবসা পাল্টে মুন্নু অ্যাগ্রো হওয়ার পর কোম্পানির আয় কমেছে। সেখানেও উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে লোকসান হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
দেড়শ শতাংশ বোনাস শেয়ার নিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরাও এখন হতাশ। এর দাম পড়ে গেছে অনেক।
প্রথমে ৫০ ও পরে ১২৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর জেমিনি সি ফুডের শেয়ারমূল্য ব্যাপকভাবে বাড়লেও পরে বিনিয়োগকারীদের পকেট ফাঁকা করেছে কোম্পানিটি।
২০২১ সালে ডেলটা লাইফ একটির বিপরীতে ২১টি বোনাস শেয়ার দেয়াকে কেন্দ্র করে শেয়ার দর বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ার পর তাতে বিনিয়োগকারীরা টাকা হারিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়ে হুলুস্থুল ফেলা ফ্যামিলিটেক্সের শেয়ার দর ২০২০ সালে এক পর্যায়ে ১ টাকা ৬০ পয়সায় নেমে আসে।