১৯৮৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি স্টাইলক্রাফট লিমিটেড প্রতিবছর ব্যাপক মুনাফা করে আলোচিত ছিল। মাত্র ৬০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ৯৫ টাকা মুনাফা করে চমক দেখায়। এরপর দফায় দফায় বিশাল বোনাস দিয়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে পরিশোধিত মূলধন ১৩ কোটি ৮৮ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা বানিয়ে এখন লোকসানে ডুবছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, পাঁচ বছর আগে স্টাইক্রাফটের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৬০ লাখ টাকা এবং শেয়ারপ্রতি আয় ছিল ৯৫ টাকা, সেই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এখন ২৩ গুণের বেশি, যা এখন লোকসানি কোম্পানিতে রূপান্তরিত।
পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়ে কোম্পানি সম্প্রসারণ হবে, এই আশায় উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীদের পকেট ফাঁকা হয়েছে।
ঈর্ষণীয় মুনাফা থেকে ক্রমাগত ডুবতে থাকার কারণ জানতে কোম্পানি সচিব এডমান্ড গোডার নম্বরে বহুবার কল করলেও কেউ ফোন ধরেননি।
তবে গত ১ নভেম্বর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানির পক্ষ থেকে লোকসানের একটি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়। সেদিন বলা হয়, শেয়ারপ্রতি আয়ে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কোভিড নাইনটিনের কারণে বিক্রি কমে যাওয়া।
এর আগে ব্যাপক হারে বোনাস শেয়ার দেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা জানানো হয়।
পুঁজিবাজারে স্টাইলক্রাফট নিয়ে আলোচনা ছিল বরাবর। শেয়ারপ্রতি ১০০ টাকার আশপাশে আয়, প্রতিবছরই তা বেড়ে চলার পরিপ্রেক্ষিতে শেয়ারমূল্যও বাড়ত নিয়মিত।
১০ টাকা অভিহিত মূল্যের দেশি উৎপাদনকারী কোম্পানির হিসেবে গত ১০ বছরে মুন্নু অ্যাগ্রোর পরে এই কোম্পানির শেয়ারদরই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
২০১৭ সালে কোম্পানিটি প্রথমবারের মতো ৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ১০টি শেয়ারে আটটি শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেয়। তখন শেয়ারের দাম বেড়ে ২ হাজার ৮০০ টাকার উপরে চলে যায়।
পরের বছর কোম্পানিটি আরও চমক দেখায়। ওই বছর প্রতি ১০০ শেয়ারে বোনাস শেয়ার হিসেবে দেয়া হয় ৪১০টি শেয়ার। আরও ব্যাপক বোনাস শেয়ার দেয়া হবে, এই খবরে দাম ছাড়ায় ৪ হাজার ৯০০ টাকা।
এই দরে যারা শেয়ারটি কিনেছেন, তারা পরের বছর আরও দেড়’শ শতাংশ অর্থাৎ দুটি শেয়ারের বিপরীতে আরও তিনটি শেয়ার বোনাস হিসেবে পাওয়ার পরও বিপুল পরিমাণে লোকসানে রয়েছেন।
চার হাজার ৯০০ টাকায় একটি শেয়ার যারা পেয়েছেন, ২০১৭ সালে ৪১০ শতাংশ বোনাস যোগ হওয়ার পর শেয়ারের দাম সমন্বয় হয় ৯৬০ টাকা। পরের বছর ১৫০ শতাংশ বোনাস যোগ হওয়ার পর দাম সমন্বয় হয় ৩৮৪ টাকা ৩০ পয়সা।
এরপর কোম্পানিটি আর বোনাস শেয়ার ইস্যু করেনি। এখন শেয়ারপ্রতি দাম ১৫০ টাকার নিচে ঘুরাফিরা করছে।
অর্থাৎ তিন বছর পর বর্তমানের সমন্বয় হওয়া শেয়ারমূল্যের হিসাবে শেয়ারপ্রতি লোকসান ২৩৪ টাকা। আগের দুই বছরের বোনাস শেয়ার বিবেচনায় নিলে শেয়ারপ্রতি লোকসান দাঁড়ায় প্রায ৩ হাজার টাকা।
অর্থাৎ ৪ হাজার ৯০০ টাকায় কিনে যিনি ৪১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার নিয়ে এখনও ধরে রেখেছেন, তার এই পরিমাণ লোকসান এখন।
এই কোম্পানির দামও মুন্নুর মতো কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। ফ্লোর প্রাইসেও এই শেয়ারের হাতবদল হচ্ছে না বললেই চলে।
গত বছর মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর পুঁজিবাজারে ধস ঠেকাতে সব শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্য বেঁধে দেয়া হয়, যার নাম দেয়া হয়েছে ফ্লোর প্রাইস।
কোম্পানির আয়, মৌলভিত্তি বিবেচনা না করেই কেবল বাজারমূল্যের বিবেচনায় এই ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাধারণত কোম্পানি খারাপ করতে থাকলে শেয়ারদর নেমে আসে। কিন্তু স্টাইলক্রাফট খারাপ করতে থাকলেও এর শেয়ারদর বেঁধে দেয়ায় ওই দামের চেয়ে নামতে পারছে না। কিন্তু এই দাম যে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না, তার প্রমাণ শেয়ার হাতবদলের সংখ্যা।
কোম্পানিটি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারানোর কারণ এর ব্যালান্সশিট ক্রমাগত নিম্নমুখী হওয়া। গত বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৫৩ পয়সা আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে লোকসান হয়েছে ১ টাকা ৮০ পয়সা।
গত এক দশকে যেসব কোম্পানি মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন হঠাৎ করে বাড়িয়েছে, তার সিংহভাগের পরিণতিই স্টাইল ক্রাফটের মতো।
মুন্নু স্টাফলার পরিশোধিত মূলধন প্রায় ছয় গুণ বাড়িয়ে কোম্পানির নাম ও ব্যবসা পালটে মুন্নু অ্যাগ্রো হওয়ার পর কোম্পানির আয় কমেছে। সেখানেও উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে লোকসান হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
প্রথমে ৫০ ও পরে ১২৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর জেমিনি সি ফুডের শেয়ারমূল্য ব্যাপকভাবে বাড়লেও পরে বিনিয়োগকারীদের পকেট ফাঁকা করেছে কোম্পানিটি।
২০১২ সালে ডেলটা লাইফ একটির বিপরীতে ২১টি বোনাস শেয়ার দেয়াকে কেন্দ্র করে শেয়ারদর বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ার পর তাতে বিনিয়োগকারীরা টাকা হারিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।
২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর ফ্যামিলিটেক্সের শেয়ারের মূল্য ৭৪ টাকা ৮০ পয়সা হয়ে যায়। পরে তা কমতে কমতে ২০২০ সালে ১ টাকা ৬০ পয়সায় নামে।
তবে ব্যতিক্রম অবস্থায় রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি- ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বা বিএটিবিসি। মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়ে দরপতনের দৌঁড়ে বহুজাতিক কোম্পানিটি এগিয়ে রয়েছে। ২০১৮ ও ২০২০ সালের জন্য ২০০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার দিয়ে কোম্পানিটি পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়েছে ৯ গুণ।
শেয়ারটি ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৮০০ টাকা উঠে। ৯ গুণ পরিশোধিত মূলধন হওয়ার পর সেই দামের সঙ্গে সমন্বয় করা দাম দাঁড়ায় ৫১৮ টাকায়। যার দাম বর্তমানে ৬০০ টাকায় ছুঁয়েছে।