পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করতে পারে- এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের।
কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে, এ সংক্রান্ত আদেশ জারির আগে বা পরে বিএসইসির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ এই দুটি সিদ্ধান্ত পুঁজিবাজারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
এই সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে। কিন্তু সেটিতে পাত্তাই দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এবার লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুমে কমছে ব্যাংকের শেয়ার দর। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দর গত কয়েক মাস ধরে বাড়লেও এক দিনে ২২ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দর হারিয়েছে ১৬টি, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়েছে যে কোম্পানিটি সবচেয়ে বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, সেটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে বিএসইসি যে খুশি নয়, সেটি সংস্থাটির কমিশনার শামসুদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের স্পষ্ট।
তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজার সংবেদনশীল জায়গা। এখানে যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করে। পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য বিএসইসি এককভাবে কিছু করতে পারবে না। প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরের সহযোগিতা। ভালো পুঁজিবাজার সবার সমন্বয় ছাড়া সম্ভব নয়।’
আরও একজন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে পুরো বিষয়টি নিয়েই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তিনটি সংস্থার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর আর বিএসইসি একসঙ্গে কাজ না করলে বাজার স্থিতিশীল হবে না। কিন্তু আমাদেরকে গুরুত্বই দেয়া হয় না।
‘মনে করা হয় আমরা ছোট। এমনও হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে আমাদেরকে বসে থাকতে হয় দীর্ঘক্ষণ। আমাদেরকে প্রয়োজনীয় সময়ই দেয়া হয় না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন, তারা এই দুটি আদেশ জারির আগে বিএসইসির সঙ্গে আলোচনা করেনি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিত অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত ও বিরক্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের প্রভিশন বা তারল্য কী পরিমাণ হতে পারে, সেটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ লভ্যাংশ দেবে-সেটা নির্ধারণ করে দিতে পারে না।’
লভ্যাংশের মৌসুমে ব্যাংকের শেয়ারের পতন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশের পর থেকে
পুঁজিবাজারে গত ডিসেম্বর থেকে টানা দুই মাস যে উত্থান হয়, তাতে খুব একটা বাড়েনি ব্যাংকের শেয়ারের দর। যখন এই খাতের শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ বাড়াচ্ছিলেন, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লভ্যাংশ বিতরণ বিষয়ক এক নীতিমালা সে আগ্রহে পানি ঢেলে দেয়।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ বিতরণ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানানো হয়, ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নগদে আর সমপরিমাণ বোনাস লভ্যাংশ হিসেবে দিতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই ৩০ শতাংশের বেশি হবে না লভ্যাংশ।
শর্তভেদে কোনো কোনো ব্যাংক সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারবে। আর কোনোটি পাঁচ শতাংশ নগদ (শেয়ার প্রতি ৫০ পয়সা) ও সম পরিমাণ বোনাস, কোনোটি সাড়ে সাত শতাংশ নগদ (শেয়ার প্রতি ৭৫ পয়সা) ও সমপরিমাণ বোনাস, কোনোটি ছয় শতাংশ নগদ (শেয়ার প্রতি ৬০ পয়সা) ও সমপরিমাণ বোসান, কোনোটি পাঁচ শতাংশ নগদ (শেয়ার প্রতি ৫০ পয়সা) ও সম পরিমাণ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণ করতে পারবে।
এই নীতিমালা জারির পর থেকে ব্যাংকের শেয়ারের দর কমেছে টানা দুই সপ্তাহ।
নীতিমালা জারির দিন এ বি ব্যাংকের শেয়ার দর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা। বৃহস্পতিবার বাড়ার পরেও তা দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা ৫০ পয়সা।
আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের দাম এই সময়ের মধ্যে ২২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ২০ টাকা ৫০ পয়সা। ব্র্যাক ব্যাংকের দাম ৪৯ থেকে কমে হয়েছে ৪৩ টাকা ৭০ পয়সা।
সিটি ব্যাংকের দাম ২৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে কমে ২৫ টাকা ২০ পয়সা, এক্সিম ব্যংকের দাম ১১ টাকা ৯০ পয়সা থেকে কমে ১০ টাকা ২০ পয়সা, ন্যাশনাল ব্যাংকের দাম ৮ টাকা ৪০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৭ টাকা ৫০ পয়সা।
একই রকম আদেশে কমল আর্থিক খাতের শেয়ার দর
ব্যাংক নিয়ে এই দশার মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি জারি করা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ঘোষণা বিষয়ক নির্দেশনা।
এতে বলা হয়, কোনো প্রতিষ্ঠান যতই মুনাফা করুন, শেয়ারধারীদের ১৫ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ার প্রতি দেড় টাকার বেশি লভ্যাংশ দেয়া যাবে না। আর যাদের খেলাপিঋণ ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি তারা কোনো লভ্যাংশই দিতে পারবে না।
এই সিদ্ধান্ত আসার আগেই লভ্যাংশ ঘোষণা করে তিনটি প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে আইডিএলসি ফিনান্স ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি সাড়ে তিন টাকা, আইপিডিসি ফিনান্স শেয়ার প্রতি এক টাকা ২০ পয়সা আর বিডি ফিনান্স শেয়ার প্রতি ৬০ পয়সা নগদ ও প্রতি ১০০ শেয়ারে ছয়টি বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে।
কিন্তু নীতিমালা জারির কারণে এই লভ্যাংশ বিতরণ করা যাবে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।
তিনটি প্রতিষ্ঠানই করোনাকালে গত বছরের চেয়ে বেশি মুনাফা করেছে। তার পরেও বাংলাদেশ ব্যাংক কেন মুনাফায় লাগাম দিল, তা নিয়ে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট নানা ফেসবুক পেজে প্রশ্ন তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা।
এই নির্দেশনা জারির পর আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের মূল্য পতন হয়েছে ব্যাপকভাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে আইডিএলসির শেয়ার, যেটির লভ্যাংশ শেয়ার প্রতি দুই টাকা কমে যাবে।
সমন্বয়হীনতা নিয়ে আক্ষেপ আগেও করেছে বিএসইসি
২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএসইসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হেলালউদ্দিন নিজামী ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তাদের সমন্বয়হীনতা নিয়ে আক্ষেপ করেন।
সেদিন তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজার সম্পৃক্ত কোনো কিছু জারি করতে গেলে বিএসইসির সঙ্গে আলাপ করে নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, আইডিআরএ এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
‘আগেও সমন্বয়ের বিষয়ে বলা হয়েছিল, কিন্ত নানা কারণে সেটি হচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি সমন্বিত প্রয়াশে পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নিতে।’
যা বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সার্কুলার দেয়ার আগে বিএসইসি সঙ্গে আলোচনা না করার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সরাসরি কোনো জবাব দেননি। তবে তিনি বলেন, তাদের সিদ্ধান্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এই ব্যাপারে আলটিমেটলি পুঁজিবাজারকেই সহযোগিতা করা হয়েছে। কারণ, যখন একটা প্রতিষ্ঠানের মূলধন বৃদ্ধি করার জন্য যদি পদক্ষেপ নেয় এটা পুঁজিবাজারকে আরও সংহত করে।’
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘ডিভিডেন্ট (লভ্যাংশ) কেউ ডিক্লেয়ার করল ৩০ শতাংশ। কিন্তু এই ৩০ শতাংশ তো পরিচালক নিয়ে চলে গেল।কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি, সঞ্চিতি বৃদ্ধি করার জন্য যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা নির্দেশনা থাকে যে এর বেশি ডিভিডেন্ট দেয়া যাবে না, এতে আলটিমেটলি একটা প্রতিষ্ঠানের আরো মেরুদণ্ড শক্ত হয়। এটাকে তো আমি খারাপ ভাবে দেখি না।’
সিদ্ধান্তের কারণে শেয়ারের দর কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন- এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘যে যে প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমে তাদের অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। …সবগুলো যে কমছে তা তো নয়, বাড়ছেও। কী কী কারণে বাড়ছে সেটাও তো দেখার দরকার আছে।’