পাঁচ কার্যদিবস ধরে কেবল শেয়ারমূল্য ও সূচক কমছে না, টানা কমছে লেনদেন। আগের দিন ৭৪ পয়েন্টের পর এবার পতন হয়েছে ৫০ পয়েন্ট। কমেছে বেশিরভাগ শেয়ারের লেনদেন। জানুয়ারির মাঝামাঝি যেখানে লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকার ঘরে, সেটি কমতে কমতে নেমেছে সাতশ কোটি টাকার ঘরে। গত এক দশকের আস্থাহীনতার কারণে উদ্বেগে বিনিয়োগকারীরা।
শেয়ারবাজারে টানা পাঁচ কার্যদিবস ধরে কমছে লেনদেন। সূচকের উত্থান-পতনের মধ্যে লেনদেন কমে আসায় প্রশ্ন উঠেছে এটি কি মূল্য সংশোধন, নাকি ধারাবাহিক দরপতন।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারের মূল্য সংশোধন হচ্ছে। তবে লেনদেন কমা নিয়ে তাদের মধ্যে আছে মিশ্র ভাবনা।
আর সংশোধন এত দীর্ঘায়িত হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্ন করছেন বিনিয়োগকারীরা।
পাঁচ কার্যদিবস ধরে কেবল শেয়ারমূল্য ও সূচক কমছে না, টানা কমছে লেনদেন।
সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবস সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে- ডিএসই লেনদেন হয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা।
এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর ডিএসইতে লেনদনে হয়েছিল ৭১৯ কোটি টাকা। এরপর আর এত কম লেনদেন হয়নি।
গত ২১ ডিসেম্বর থেকে টানা এক মাসেরও বেশি ধরে শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। পাঁচ দিন লেনদেন হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু গত চার কার্যদিবস ধরে আবার এক হাজার কোটি টাকার নিচে নেমেছে লেনদেন। তা-ও প্রতিদিনই কমছে।
লেনেদেনের পাশাপাশি কমছে শেয়ারমূল্য, সূচক, বাজার মূলধন। গত এক দশক ধরে আস্থাহীনতার যে কথা বারবার বলা হচ্ছিল, সেটি নিয়ে আবার উৎকণ্ঠিত বিনিয়োগকারীরা।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে মূলত উত্থান শুরু হয়ে শেয়ারবাজারে। বাড়তে থাকে সূচক ও লেনদেন। ধরাবাহিক হাজার কোটি টাকার লেনদেন সর্বোচ্চ উঠে আড়াই হাজার কোটি টাকায়।
লেনদেনের উত্থানে আলোচনায় আসে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা ও রবি।
টেলিকমিউনিকেশন খাতের নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে রবির প্রতি আগ্রহ ছিল বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বেশি। কিন্তু দেশের করোনা টিকা দেশে আনার ক্ষেত্রে বেক্সিমকো গ্রুপের সম্পৃক্ততার কারণে আগ্রহের শীর্ষে চলে আসে বেক্সিমকো ফার্মাও।
সর্বশেষ আর্থিক বিবরণীতেও বেক্সিমকো লিমিটেডের আয়ের ইতিবাচক প্রভাব বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কিনতে বাড়তি আগ্রহ যোগ করে।
ফলে ডিসেম্বরে যে কোম্পানির শেয়ারের দর ছিল ২৩ টাকা তা বেড়ে উঠেছে ৯০ টাকায়। একই সঙ্গে ডিসেম্বরে তালিকাভুক্ত হয়ে ১০ টাকার রবির শেয়ার মাত্র ১৬ কার্যদিবসে দর বেড়ে হয় ৭১ টাকা।
এরপর থেকেই শুরু হয় মূল্য পতন। রবির শেয়ারের দর এখন ৫১ টাকায়। যদিও বেক্সিমকো সেই তুলনায় দর ধরে রেখেছে অনেকটাই।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘যেভাবে শেয়ারবাজারের উত্থান হয়েছে তাতে মূল্য সংশোধন জরুরি ছিল। কিন্ত লেনদেন যেভাবে কমে আসছে তাতে সন্দেহ হচ্ছে, বাজার থেকে কেউ টাকা নিয়ে যাচ্ছে কি না।’
তিনি বলেন, ‘রবির শেয়ারের দর যে পর্যায়ে পৌছেছিল তাতে এর মূল্য সংশোধন প্রয়োজন ছিল। আর হচ্ছেও। আর বেক্সিমকোর শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে। পাশাপাশি অনেক কোম্পানির শেয়ারের দরও অস্বাভাবিকভাবে কমে এসেছে।’
ফলে হঠাৎ করে কেন লেনদেনের কমে আসছে, সেটিও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুসন্ধান করা উচিত বলে মনে করেন আবু আহমেদ।
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শেয়ারবাজারে ভালো হচ্ছিল দেখে আশান্বিত হয়েছিলাম। নতুন করে বিনিয়োগও করা হয়েছে। কিন্ত এখন যেভাবে লেনদেনসহ শেয়ারের দর কমেছে, তাতে আতঙ্কিত যে বিনিয়োগ সঠিকভাবে ফেরত পাব কি না।’
তিনি বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা শেয়ারবাজারে ভালো করার জন্য যেমন বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করে, তেমনি যখন ক্রমাগত লেনদেন কমতে থাকে তখনো নজরদারি করা উচিত। এবং সে সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের অবগত করা উচিত। তাহলেই পুঁজিবাজার থেকে আস্থাহীনতা দূর হবে।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘দুই হাজার কোটি টাকা যখন শেয়ারবাজারে লেনদনে হয় তখন স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, এখানে নতুন বিনিয়োগ হয়েছে। ফলে যারা বিনিয়োগ করছেন, তারা মুনাফা করবে। মূলত মুনাফা উত্তোলনের কারণেই শেয়ারের দর কমছে।’
তিনি বলেন, ‘দুই হাজারে কোটি টাকা থেকে এক দিনেই কিন্ত সাতশ কোটি টাকা হয়নি। লেনদেন কমেছে ধাপে ধাপে। ফলে এখানে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ সময়ে যেসব কোম্পানির শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত হয়েছে, এখন সেগুলোর দর কমেছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা আগের তুলনায় অনেক সক্রিয়।’
মন্দা বাজারে তেজিভাবে বিমা
সোমবার লেনদেন সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল তালিকাভুক্ত বিমা খাতের কোম্পানিগুলো।
এদিন লেনদেন হওয়া বিমা খাতের ৪৯টি কোম্পানির মধ্যে মাত্র তিনটি কোম্পানির শেয়ারের দর কমেছে। একটির দর পাল্টায়নি। বাকি সবগুলোর দর বেড়েছে।
শীর্ষ দর বৃদ্ধি পাওয়া ১০ কোম্পানির তালিকায় ছয়টিই বিমা খাতের।
তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে চারটি কোম্পানির শেয়ারের দর বেড়েছে। দর পাল্টায়নি ১১টি ব্যাংকের। বাকি সবগুলোর দর কমেছে।
প্রকৌশল খাতের ৪১টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে তিনটির। ২০টির দর কমেছে। বাকিগুলোর দর পাল্টায়নি।
সূচক ও লেনদেন
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে-ডিএসই প্রধান সূচক ডিএসইএক্স আগের দিনের তুলনায় ৫০ দশমিক ০৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৫৯৯ পয়েন্টে।
শরিয়াহভিত্তিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসইএস ১১ দশমিক ২৩ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৫৪ পয়েন্টে।
বাছাই করা কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস-৩০ সূচক ৩৪ দশমিক ৯০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১২৫ পয়েন্টে।
এদিন লেনদেন হওয়া ৩৬৬টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১১০টির, কমেছে ১৩৮টির ও পাল্টায়নি ১০৮টির।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে-সিএসই প্রধান সূচক সিএএসপিআই ১৭৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ২৯৬ পয়েন্টে।
লেনদেন হওয়া ২৩৪টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ৬৮টির, কমেছে ১১১টির ও পাল্টায়নি ৫৫টির। এদিন সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২৭ কোটি টাকা।
দর বেড়েছে কমেছে
সোমবার দর বৃদ্ধির শীর্ষে থাকা অগ্রণী ইন্স্যুরেন্সের দর বেড়েছে ১০ শতাংশ। তারপরেই ছিল এম আই সিমেন্ট, যার দর বেড়েছে ৯.৯৮ শতাংশ।
প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের শেয়ারের দর বেড়েছে ৯.৯৭ শতাংশ। জিকিউ বলপেনের শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৯১ শতাংশ।
এছাড়া এ তালিকায় ছিল প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সোনালী আঁশ ও নর্দান ইন্স্যুরেন্স আছে সবচেয়ে বেশি দর বৃদ্ধির তালিকায়।
দর পতনের দিক দিয়ে শীর্ষে ছিল এনভয় টেক্সটাইল, যার দর কমেছে ৬.৬৯ শতাংশ। তুং হাই লিমিটেডের শেয়ার দর কমেছে ৬.২৫ শতাংশ। কাশেম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের শেয়ার দর কমেছে ৫.৫২ শতাংশ।
লেনদেনে শীর্ষে বেক্সিমকো লিমিটেড, যার এক কোটি ৬৩ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১৪০ কোটি টাকায়। আগের দিন রোববার বেক্সিমকোর এক কোটি ৭৬ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, যার তিন লাখ ৬০ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৪ কোটি টাকায়।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা লংকাবাংলা ফিন্যান্সের এক কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪০ কোটি টাকায়।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা রবির মোট ৭৬ লাখ ৮৬ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪০ লাখ টাকায়। আগের দিন রবির এক কোটি তিন লাখ ১০ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৫৫ কোটি টাকায়।