বেবিচক ও এনবিআরের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ছাড়িয়েছে পাঁচশ কোটি টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শঙ্কা, ভাড়ার দুটি উড়োজাহাজ ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা গোটাবে প্রতিষ্ঠানটি।
ফ্লাইট শুরু নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে বেসরকারি রিজেন্ট এয়ারলাইন্স। গত ১০ মাসে কয়েক দফা ঘোষণা দিয়েও ফ্লাইট শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। সবশেষ জানুয়ারিতে ফ্লাইট শুরুর কথা থাকলেও ব্যর্থ হয়েছে সে উদ্যোগ।
রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, মার্চে ফ্লাইট শুরু করবে তারা। অবশ্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, দেনা শোধ না হলে এয়ারলাইন্সটিকে ফ্লাইট চালানোর অনুমতি দেয়া হবে না।
দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে গত বছরের মার্চ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট চলাচল সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে বেসরকারি এই এয়ারলাইন্সটি। সেই থেকে পাইলট এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আছেন অবৈতনিক ছুটিতে।
এরই মধ্যে বেবিচক ও এনবিআরের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ছাড়িয়েছে পাঁচশ কোটি টাকা। বন্ধ হওয়ার আগে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করা টিকিটের টাকাও ফেরত দেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শঙ্কা: ভাড়ার দুটি উড়োজাহাজ ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা গোটাবে প্রতিষ্ঠানটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রিজেন্টের এক জ্যেষ্ঠ পাইলট বলেন, ‘স্টাফদের কিংবা সিভিল অ্যাভিয়েশনকে দেয়া কোনো কমিটমেন্টই তারা রাখেনি। সিভিল অ্যাভিয়েশন তাদের কাছে প্রায় ৩শ কোটি টাকার মতো পায়। এনবিআর পায় ১৯০ কোটি টাকা। গত বছরের জুন পর্যন্ত তাদের মার্কেটে বকেয়া আছে সাড়ে ৮শ কোটি টাকা।
‘আমরা পাইলটরা গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে কোনো বেতন পাচ্ছি না। অন্যরাও একইভাবে পাচ্ছে না। তিন থেকে চার শতাংশ মে মাস পর্যন্ত বেতন পেয়েছে। তারা বলেছিল, জুন মাস থেকে তারা শুরু করবে, নতুন প্লেন আসবে। সেই জুন মাস হয়ে গেছে সাত মাস আগে। প্লেন আসা তো দূরের কথা, কোনো অ্যাকশনই তারা নেয়নি। ’
এই পাইলটের আশঙ্কা, রিজেন্ট যে ‘এয়ারওয়ার্দিনেস সার্টিফিকেটের’ (নিরাপদ উড্ডয়নের উপযুক্ততার ছাড়পত্র) জন্য আবেদন করেছে, এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তারা এওসি রিন্যুয়াল করছে একটি মাত্র কারণে- তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো যেন বন্ধ হয়ে না যায়। এটা একটা ট্রাম্প কার্ড হিসেবে তারা দেখাচ্ছে। আমাদের এই একটা প্লেন তো আছে।’
রিজেন্টের আরেক পাইলট জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে বহরে থাকা দুটি বোয়িং সেভেন থ্রি সেভেন উড়োজাহাজের মধ্যে একটির টেস্ট ফ্লাই সম্পন্ন করেছে রিজেন্ট। তিনি বলেন, ‘এই প্লেনের দুটি ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম অনুসারে ইঞ্জিন পরিবর্তন করলে বাধ্যতামূলকভাবে টেস্ট ফ্লাই করতে হয়।
‘এটা ছাড়া প্লেন আকাশে উড়বে না। তারা যে এটাকে ফেরি করে দেশের বাইরে পাঠাবে, এটাও করতে পারবে না। প্লেনকে সার্ভিসেবল রাখার জন্য যে কন্টিনিউয়াস ফ্লাইং, সেটা তারা কখনও করেনি।’
টেস্ট ফ্লাইয়ের পর গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর এই উড়োজাহাজটিকে ভারতের হায়দ্রাবাদ বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। সেখানে উড়োজাহাজটির ‘সি-চেক’ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও এখনও সে কাজ শুরু হয়নি।
রিজেন্টের ওই পাইলট বলেন, ‘সেই থেকে প্রত্যেকদিন পার্কিংয়ের জন্য তারা চারশ ডলার করে ফি দিয়ে আসছে। একটা কারণেই এটি করেছে, যদি এখানে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়, তাহলে যেন প্লেনটি বাজেয়াপ্ত করা না যায়।’
রিজেন্ট এয়ারে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ২০ জন পাইলট। এদের মধ্যে ১১ জন ক্যাপ্টেন আর ৯ জন ফার্স্ট অফিসার। গত ১০ মাসে একেকজন পাইলটের বেতন জমেছে গড়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা করে। আর একেকজন ফার্স্ট অফিসারের প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
শুধু বকেয়া বেতনই নয়, বন্ধ হওয়ার পর পাইলটদের সক্রিয় রাখতে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণগুলোও শেষ করেনি রিজেন্ট। আন্তর্জাতিক বেসমারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিয়মানুসারে প্রত্যেক পাইলটকে নির্দিষ্ট সময় পরপর বাধ্যতামূলকভাবে সিম্যুলেটরে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হয়।
এয়ারলাইন্সটির বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিষ রায় চৌধুরী ব্যবসা গোটানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মার্চ থেকে ফ্লাইট শুরু করব। আমাদের এয়ারক্রাফট আসছে ফেব্রুয়ারির শেষে। সে হিসেবেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
‘সিভিল অ্যাভিয়েশনের যে পাওনা আছে, সেগুলো তাদের যেভাবে কথা হয়েছে সেভাবেই প্রত্যেক মাসে মাসে আমরা পরিশোধ করছি। যদি ব্যবসা গোটানোর ইচ্ছাই থাকতো, তাহলে এই টাকা কেন পরিশোধ করছি? কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও আমরা পরিশোধ করব।’
রিজেন্ট মার্চে ফিরতে চাইলেও বেবিচক বলছে, পাওনা শোধ না হওয়া পর্যন্ত ফ্লাইট চালুর অনুমতি পাবে না তারা। নিয়ন্ত্রক এ সংস্থার ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের সদস্য চৌধুরী এম জিয়া উল কবির বলেন, ‘তাদেরকে একটা লিমিটেড সময়ের জন্য আমরা এওসি দিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের ডিউসগুলো অনেক বেশি হয়ে গেছে। এজন্য তাদেরকে আমরা এই মুহূর্তে হোল্ডে রেখেছি।
‘তাদেরকে তিন মাস সময় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারা যদি তাদের কমপ্লায়েন্সগুলো ফুলফিল করতে পারে, তাহলে তাদেরকে আবার ফ্লাইটের পারমিশন দেব। এর জন্য আবার তাদের অডিট করা হবে। সেখানে যদি সব কিছু ঠিক থাকে, তাহলে ফ্লাইট শুরুতে বাধা নেই।’
রিজেন্ট এয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর। এক দশক যেতে না যেতে জোর ধাক্কা খেল এয়ারলাইন্সটি। বন্ধ হওয়ার আগে দেশের ভেতরে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং আন্তর্জাতিক গন্তব্য কলকাতা, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, মাসকট ও দোহায় ফ্লাইট চালাচ্ছিল এয়ারলাইন্সটি।
গত প্রায় দুই যুগে দেশে ১০টি বেসরকারি এয়ারলাইন্স যাত্রা শুরু করলেও এখন টিকে আছে মাত্র দুটি। এ সময়ের মধ্যে একে একে পাখা গুটিয়েছে অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবত, রয়েল বেঙ্গল, এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, বেস্ট এয়ার ও ইউনাইটেড এয়ার। এদের মধ্যে শুধু জিএমজি ও ইউনাইটেড আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালাত।