কভিডের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। চাকরি হারিয়েছে অনেক মানুষ। এমনকি লকডাউন শিথিল করার পরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি অর্থনীতি। ব্যাংক সুদের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এতে বাধ্য হয়ে রিটার্নের আশায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করে মানুষ। যার প্রভাবে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার সব অঞ্চলের পুঁজিবাজারগুলোতে চাঙ্গা ভাব দেখা দেয়। কভিড যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি পুঁজিবাজারেও হঠাৎ জোয়ার দেখা দেয়ায় অর্থনীতিবিদরা এটাকে বলছেন পুঁজিবাজারে কভিড সিনড্রোম। কিছুটা বিলম্বে হলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও কভিড সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে এখন।
কভিডের কারণে দেশে সাধারণ ছুটির সময় ৬৬ দিন বন্ধ ছিল পুঁজিবাজারের লেনদেন। তার ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বের প্রতি আস্থা সংকট ছিল বিনিয়োগকারীদের। তবে মে মাসে বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্ব পরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার আবার চালু হলে ধীরে ধীরে মানুষ বিনিয়োগে ফিরতে শুরু করে। এতে প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করে দেশের পুঁজিবাজারে। সর্বশেষ গতকাল ডিএসইএক্স ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে।
গত বছরের এপ্রিল থেকে ঋণ ও আমানতের সুদের হার নয়-ছয় কার্যকর করে ব্যাংকগুলো। এতে মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়ে ব্যাংক আমানত থেকে ১ শতাংশের বেশি সুদ আয় পাওয়া সম্ভব নয় বললেই চলে। তার ওপর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের রাশ টানতে টিআইএন বাধ্যতামূলক করে দেয় সরকার। এতে এ খাতেও বিনিয়োগের প্রবণতা কমে যায়। তার ওপর কভিড-১৯-এর কারণে সার্বিক অর্থনীতিও শ্লথ হয়ে গেছে। ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে ফ্ল্যাট, জমির পাশাপাশি ব্যাংক আমানত ও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার জন্য ব্যাপক ছাড় দেয়। যার প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারেও। বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে সূচক। পাশাপাশি ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে পুঁজিবাজারের লেনদেন।
পুঁজিবাজারে সূচকের এ উত্থানে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বিনিয়োগকারীরও অংশগ্রহণ ছিল। কভিডকালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। একই সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে দেশে থাকা স্বজনদের কাছে বেশি অর্থ পাঠানোর প্রবণতাও দেখা গেছে। এতে কয়েক মাস ধরেই একের পর এক রেকর্ড ভাঙছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু ব্যাংক সুদের হার কমে যাওয়ায় এ অর্থ এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন প্রবাসীরা। গত বছরের ১৮ মার্চ দেশের পুঁজিবাজারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ১৫১টি। আর সর্বশেষ এ বছরের ১৩ জানুয়ারি এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ১২৪টিতে। এ সময়ে প্রবাসীদের বিও হিসাব বেড়েছে ১০ হাজার ৯৭৩টি।
করোনাকালে সূচকের উত্থান ও বিনিয়োগের প্রবণতার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বণিক বার্তাকে বলেন, সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে বেশি রিটার্নের আশায় অনেকেই তাদের সঞ্চিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন। তাছাড়া সরকার অপ্রদর্শিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে, সে সুযোগও নিচ্ছেন অনেকে। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিশেষ করে পর্যটন খাতের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, করোনার কারণে তাদের আয়-রোজগার নেই বললেই চলে। তারা রিটার্নের কারণে পুঁজিবাজারে আসছেন বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং অনেক নতুন তহবিল এসেছে। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে সূচকের উত্থানে। তবে সূচক বাড়ার চেয়ে এটি ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য নতুন ভালো মৌলভিত্তির দেশী কোম্পানির পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনার ওপর জোর দেন তিনি।
কভিড-১৯-এর কারণে পুঁজিবাজারের উত্থানের গল্প শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর। বিশ্বের প্রায় সব দেশের পুঁজিবাজারেই কভিডের সময়ে আশাতীত রিটার্ন এসেছে। অবশ্য বৈশ্বিক পুঁজিবাজারের রিটার্নের দিক দিয়ে বাংলাদেশ অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। ওয়াল স্টিট জার্নালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে ব্রাজিলের বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ার বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের নাগরিকরা সাধারণত পুঁজিবাজারবিমুখ। এর কারণও আছে। ২০১৬ সালেও সেখানে ব্যাংক আমানতের সুদ হার ছিল ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ কারণে সবাই নিশ্চিন্তে ব্যাংকে টাকা রেখে সুদ ভোগ করত। নিম্ন মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি আইনি কারণে ব্রাজিলের ফেডারেল সরকারের অর্থ ব্যয় লাগাম টানা হয় এবং এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সুদের হার কমানোর সুযোগ পায়। কভিডের কারণে এটি আরো গতি পায়। গত বছরের আগস্টে ব্রাজিলে সুদের হার মাত্র ২ শতাংশে দাঁড়ায়। এর ফলে যারা কখনো এর আগে পুঁজিবাজারে আসার কথা চিন্তাও করতেন না, তারা সবাই পুঁজিবাজারে আসতে শুরু করে। এতে গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত সাওপাওলো ভিত্তিক বি৩ এক্সচেঞ্জের বেঞ্চমার্ক সূচক ইবোভেসপা ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ব্রাজিলের বিনিয়োগকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ও জ্ঞান অর্জন করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে ঝুঁকিও থাকছে। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন বিনিয়োগকারীরা কোনো সঠিক ও ভুল তথ্যের মধ্যে ফারাক করতে পারছে না। ব্রাজিলের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আরেকটি লক্ষণীয় দিক হচ্ছে, তাদের প্রায় অর্ধেকই তরুণ এবং তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে, যা ২০১৭ সালে ছিল ২৮ শতাংশ।
প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন ইসরায়েলের ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি পেসাগট সিকিউরিটিজ লিমিটেডের সিইও তামারা দিরেকতর। প্রতিদিনই সকালে কম্পিউটার চালু করার পর থেকে রাতের বেলা বন্ধ করার আগ পর্যন্ত শেয়ার কেনা-বেচা করার জন্য প্রচুর পরিমাণে নতুন হিসাব খোলার আবেদন জমা পড়তে থাকে তার কার্যালয়ে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১০ গুণ বেশি আবেদন জমা হচ্ছে প্রতিদিন। যদিও এজন্য তাদের কোনো ধরনের প্রচার-প্রচারণা বা বিজ্ঞাপন দিতে হয়নি। অ্যাপ ও ডিজিটাল মাধ্যম বিনিয়োগকারীদের সহজে পুঁজিবাজারে লেনদেনের সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনকি সেখানে মানুষ বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট কেনার জন্য সঞ্চিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য খাটাচ্ছে।