স্টক মার্কেটে প্রতি ১০০ বিনিয়োগকারীর মধ্যে ৯০ জন প্রথম পাঁচ বছরে তার সম্পূর্ণ পুঁজি হারিয়ে ফেলেন। অবশিষ্ট ১০ জন সৌভাগ্যবানদের মধ্যে মাত্র ৬ জন গড় মুনাফা করেন। আর ৪ জন অতি সৌভাগ্যবান বিনিয়োগকারী। তারা অসম্ভব রকম মুনাফা করতে পারেন। তাদের আমরা সুপার ইনভেস্টর হিসেবে জানি ও চিনি। যেমন – ওয়ারেন বাফেট, চার্লস মঙ্গার, জর্জ সরস, পিটার লিঞ্চ থেকে শুরু করে পাশের দেশ ভারতের রাকেশ জুঞ্জুনওয়ালা।
মাত্র দশ শতাংশ সফল হবার সম্ভবনা নিয়ে শত-শত বছর ধরে মানুষ পুঁজিবাজারের প্রতি আকৃষ্ট। এর কারণ সম্ভবত সেই অতি-সৌভাগ্যবান চার শতাংশ বিনিয়োগকারী, যারা অকল্পনীয় মুনাফা করেন। আর ঝামেলাহীন পরিবেশে স্বল্প পরিশ্রমে আশাতীত পরিমাণ সম্পদশালী হবার একমাত্র আইনসিদ্ধ উপায় হল পুঁজিবাজার। ৯০ ভাগ ব্যর্থ হবার ঝুঁকি। তবুও পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষ পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ করেন।
বিনিয়োগকারীদের ব্যর্থ হবার পেছনে মূলত দায়ী বাজারের গঠনশৈলী। ষোড়শ শতাব্দীতে ডাচরা সর্বপ্রথম ইউরোপে ‘পুঁজি বাজার’ ধারনার জন্ম দেয়। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল দুটি –
জন সাধারণের ছোট-ছোট পুঁজি একত্রিত করে বড় পুঁজি গঠন করা।
অলাভ/সল্প লাভজনক ব্যবসা থেকে বের হবার ‘এক্সিট রুট’ তৈরি করা।
সেই থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া যেখানেই পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানেই প্রাধান দুটি উদ্দেশ্য অটুট রাখা হয়েছে। ফল স্বরূপ অল্পকিছু মানুষ অসম্ভব বিত্তশালী হয়েছে, আর অন্যদিকে অধিকাংশ লোক হারিয়েছেন পুঁজি। কারণ পুঁজিবাজারে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে অধিক বিনিয়োগকারীর পক্ষে মুনাফা করা অসম্ভব।
পুঁজিবাজার এমন এক বাজার যেখানে কোন কোম্পানি তার মালিকানা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি (আইপিও) করে থাকে। যদি কোন কোম্পানি খুব ভাল ব্যাবসা করে এবং তার মালিক পক্ষের কাছে ব্যবসা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকে, তবে ঐ কোম্পানি কোনকালেই পুঁজি বাজারে আসবে না। কারণ বাধ্য না হলে অথবা অর্থের প্রয়োজন না থাকলে মালিক পক্ষ অযথা তার ব্যবসায়িক মুনাফার ভাগ সাধারণ মানুষকে দেবে না।
তাই মোটা দাগে পুঁজিবাজারে আইপিও ছেড়ে লিস্টেড হওয়ার মূল কারণ চারটি –
(ক) আইনী বাধ্যবাদকতা : কোম্পানি যথেট মুনাফা করছে, মালিকদেরও অর্থের প্রয়োজন নেই কিন্তু দেশের আইন মেনে ব্যবসা করার জন্য বাধ্য হয়ে পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়। যেমন- বাংলাদেশের ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলোকে ব্যবসা শুরুর তিন বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে লিস্টেড হতে হয়।
(খ) স্বল্প পুঁজি কিন্তু সম্ভবনাময় : কোম্পানিগুলোর শুরু কম পুঁজি দিয়ে কিন্তু ব্যবসায়িক আইডিয়া চমৎকার। ব্যবসা করতে নেমে মালিকরা সফল হন। এখন বড়পুঁজি যোগাড় করা সম্ভব হলে অল্প সময়ে ব্যবসা কয়েকগুণ বড় করা সম্ভব। যেমন- স্কয়ার ফার্মা, অলিম্পিক, সামিট পাওয়ার, ইফাদ অটো ইত্যাদি।
(গ) ব্যবসায়িক মুনাফা বৃদ্ধি : আর্থিক সঙ্কট নেই, ব্যবসাও মন্দ নয়। তবু অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা নেয়ার জন্য কিছু কোম্পানি বাজারে আসে। যেমন আমাদের দেশে কর্পোরেট ট্যাক্স হার ৩৭.৫% কিন্তু লিস্টেড কোম্পানির জন্য এই হার ২৫%। আবার মোবাইল কোম্পানির কর হার ৪২.৫% কিন্তু লিস্টেড ফোন কোম্পানির জন্য তা ৪০% শতাংশ।
আবার বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানিকে প্রথম ৫ বছর কোন কর দিতে হয়না। এরপর থেকে কর্পোরেট ক্যাটাগরিতে কর দিতে হয়। ফলে অনেক কোম্পানি এই কর রেয়াত পাবার জন্য বাজারে লিস্টেড হয়। যেমন- জিপি, ম্যারিকো, হাইডেল বার্গ, রাকা পাওয়ার, ইউনাইটেড পাওয়ার ইত্যাদি।
(ঘ) অলাভ/স্বল্প লাভজনক ব্যবসা বিক্রি করে দেয়া : দুঃখজনক হলেও পুঁজিবাজারে অধিকাংশ কোম্পানি লিস্টেড হয় তাদের ব্যবসা সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে দিতে। মূলত মালিক পক্ষ ও ব্যাংক উভয়ে মিলে এই কাজ করে। মালিক পক্ষ তাদের পুঁজি অনকে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তার ব্যবসা দাঁড় করান। কিছুদিন পরে তারা উভয়ে বুঝতে পারেন- যতটুকু মুনাফার আশায় তারা ব্যবসা গড়েছেন তা করার সামর্থ
তাদের নেই।
আবার এক সময়ের নামি কোম্পানি সময়ের বিবর্তনে, প্রযুক্তির পরিবর্তনে বা নিজেদের ব্যর্থতায় ব্যবসায়িক মুনাফা হ্রাস পাওয়ায় মালিক পক্ষ তাদের ব্যবসা বিক্রি করে দিতে চায়। কিন্তু ডুবন্ত জাহাজের খবর কম বেশি সবাই জানে। তাই চাইলেই অন্যকোন ব্যাবসায়ির কাছে চড়া দামে কোম্পানি বিক্রি করা সম্ভব নয়। সুতরাং বিকল্প পথ হল পুঁজিবাজার। ইউরোপের বড় বড় ব্যাংকার ও পুঁজিপতিরা এই ‘এক্সিট রুট’ তৈরি করতে পুঁজিবাজার গঠন করেছিলেন।
ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকা কোম্পানি পুঁজিবাজারে লিস্টেড করে এবং প্রথমে ধাপে ব্যাংক তার পাওনা টাকা নিয়ে যায়। দ্বিতীয় ধাপে মালিক পক্ষ শেয়ারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমাগত তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করতে শুরু করে। এক সময় তাদের হাতে নাম মাত্র পরিমাণ শেয়ার থাকে এবং অধিকাংশ শেয়ার থাকে আমজনতার হাতে। ভবিষ্যতে এই কোম্পানিগুলোর অধিকাংশ দেউলিয়া হয়ে যায়। আর অতি অল্পকিছু ক্ষেত্রে সাধারণ মার্কেট থেকে কম দামে শেয়ার কিনে অন্যকেউ মালিকানা গ্রহণ করে ব্যবসা নতুন রুপে দাঁড় করায়।
এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- ইউনাইটেড এয়ার, রহিমা ফুড, ফ্যামিলি টেক্স, সি এন্ড এ, আরএসআরএম স্টিল, ফুওয়াং ফুডসসহ অনেক কোম্পানি। এসব কোম্পানির কর্তৃপক্ষ নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এবং নতুন বিনিয়োগ আসছে বলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভেতরে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কিছু কোম্পানি সফল হয়, আর কিছু কোম্পানি ব্যর্থ হন।
তাই বিনিয়োগ করার আগে ভাবতে চেষ্টা করুণ, কেন মালিক পক্ষ তার ব্যবসা পুজিবাজারে এনেছে। দেশের প্রচলিত আইন মানতে বাধ্য হয়ে বা টেক্স সুবিধা নিতে। কিন্তু ব্যাংক ঋণ শোধ ও জন সাধারণের পুঁজিতে ব্যবসা বড় করার নামে যারা স্টক মার্কেটে আসেন তাদের সিংহ ভাগ প্রকৃত অর্থে ব্যবসা বিক্রি করে দেয়ার জন্য আসেন।
খুব কম উদ্যোক্তা জনতার পুঁজি নিয়ে ব্যবসায়িক উন্নতি করতে পারে। অতএব বিচার-বিশ্লেষণ করুণ। কেন ওই কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে? তার উদ্দেশ্য কী? ব্যবসায়িক দৈত্য হতে নাকী সময়ের সাথে বিলীন হয়ে যেতে। মাত্র দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখেন না বলেই ৯০ ভাগ বিনিয়োগকারী চরম ক্ষতিগ্রস্থ হন। এবার আপনি ভেবে দেখুন।