দেশের শেয়ারবাজার থেকে ২ দফায় ঋণ পরিশোধের কথা বলে অর্থ সংগ্রহ করেছে গোল্ডেন হার্ভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। তারপরেও কোম্পানিটি ঋণ মুক্ত হতে পারেনি। এরপরেও কিনা সেই কোম্পানিটি থেকেই বিনাসুদে উদ্যোক্তা/পরিচালকদের অন্য কোম্পানিতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানি সুদজনিত ব্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
কিন্তু ওই রক্ষা করতে গিয়ে তালিকাভুক্ত গোল্ডেন হার্ভেস্টকে সুদ দিতে হয়েছে। এতে করে প্রকৃতপক্ষে পরিচালকরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে গিয়ে সাধারন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারনা করা হয়েছে।
গোল্ডেন হার্ভেষ্ট শেয়ারবাজার থেকে প্রথম দফায় ২০১৩ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অর্থ সংগ্রহ করে। আর দ্বিতীয় দফায় ২০১৯ সালে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। এই অর্থ সংগ্রহের ১ বছর পার না হতেই কোম্পানিটির পর্ষদ ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় শেয়ারহোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশন (বিএসইসি) ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠিও দিয়েছে।
এদিকে কোম্পানিটি গত বছরের ৮ ডিসেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শেয়ারবাজার থেকে রাইট ইস্যুর জন্য অর্থ সংগ্রহ করে। ৪টি সাধারন শেয়ারের বিপরীতে ৩টি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ ২৩ হাজার ৪২০ টাকা সংগ্রহ করে। প্রতিটি শেয়ার ১০ টাকা মূল্যে ইস্যুর মাধ্যমে এই টাকা সংগ্রহ করে। এরমধ্যে ২৯ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
এর আগে ২০১৩ সালে কোম্পানিটি ব্যবসা সম্প্রসারন ও ঋণ পরিশোধের কথা বলে শেয়ারবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। প্রতিটি শেয়ার ২৫ টাকা করে ইস্যুর মাধ্যমে এই টাকা সংগ্রহ করে। ওইসময় ৩৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৩ টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করার কথা বলেছিল।
এছাড়া দফায় দফায় ঋণ পরিশোধ করতে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা গোল্ডেন হার্ভেষ্ট থেকে পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে নিয়মিত বিনাসুদে অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে সুদের উপর ঋণ নিয়ে পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানি বিনাসুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। যে কারনে পরিচালকদের কোম্পানির সুদজনিত ব্যয় না হলেও তালিকাভুক্ত গোল্ডেন হার্ভেষ্টের হয়েছে। যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির সকল শেয়ারহোল্ডারকে।
এদিকে গত ১৮ নভেম্বর গোল্ডেন হার্ভেষ্টের ‘নো’ ডিভিডেন্ডর ব্যাখ্যা চেয়ে বিএসইসির দেওয়া চিঠিতেও ঋণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৩০ জুন ২৮ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০১৭ সালের ৩০ জুন ৮৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা, ২০১৮ সালের ৩০ জুন ৭৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালের ৩০ জুন ৪৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ বা অগ্রিম হিসাবে সাবসিডিয়ারি বা সহযোগি বা একই গুপের বা কমন পরিচালকের কোম্পানিতে বিনাসুদে দেওয়া (কিছু ক্ষেত্রে নিম্ন সুদে @৬-১০%) হয়েছে। যা কমিশনের এসইসি/সিএমআরআরসিডি/২০০৬-১৫৯/এডমিন/০২-১০ নির্দেশনার বিপরীত।
এ বিষয়ে কোম্পানি সচিব নির্মল চন্দ্র সরদার বলেন, আমরা উদ্যোক্তাদের কোন কোম্পানিতে বিনাসুদে ঋণ দেই নাই। বিএসইসির চিঠির বিষয়ে আমরা ব্যাখ্যা পাঠিয়ে দিয়েছি।
এই কোম্পানিটির পর্ষদ রাইটে অর্থ সংগ্রহের পরে ৬ মাসের ব্যবধানের ব্যবসায় শেয়ারহোল্ডারদের কোন লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ সভায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের ব্যবসায় এমন হতাশার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অথচ রাইট ইস্যুর জন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এক বা প্রথম প্রান্তিকেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৮) শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) দেখায় ১.৪৬ টাকা। আর সেই কোম্পানির ২০১৯-২০ এর পুরো অর্থবছরে ০.০৪ টাকা বা ৪ পয়সা ইপিএস হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গোল্ডেন হার্ভেস্ট বিভিন্ন ড্রাই ফুড, আইসক্রীম, দুধ ইত্যাদি পণ্য তৈরী ও বাজারজাতকরন করে। করোনাভাইরাসের মধ্যেও এসব পণ্যের চাহিদা ছিল। এমনকি অস্বাভাবিক চাহিদার কারনে দুধের দাম বেড়ে গেছে। এছাড়া করোনার মধ্যে ঠান্ডা জাতীয় পণ্যে বিশেষ সতর্ক থাকতে বললেও লাভেলো আইসক্রীম মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু গোল্ডেন হার্ভেস্ট ব্যবসায় পতন দেখিয়েছে। তবে ব্যবসায় এমন পতনের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বিএসইসির নির্দেশনা থাকলেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সেটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।
এসব কারনে গোল্ডেন হার্ভেস্টের রাইট শেয়ার ইস্যুর আগের ও পরের আর্থিক হিসাব নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সন্দেহের দাঁনা বেধেছে। কোম্পানিটি রাইট ইস্যুর জন্য পূর্বে অতিরঞ্জিত মুনাফা দেখিয়েছে, অন্যথায় এখন শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে প্রতারনার জন্য ব্যবসায় ধস দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
যে কারনে বিভিন্ন কোম্পানির ন্যায় গোল্ডেন হার্ভেস্টের আর্থিক হিসাব পূণ:নিরীক্ষার দাবি তুলেছেন বিনিয়োগকারীরা। একইসঙ্গে রাইট ইস্যুর অর্থ যাতে নয়-ছয় না হয়, সেদিকে নজরদাড়ি রাখার দাবি।
উল্লেখ্য, রবিবার (২৯ নভেম্বর) লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর দাড়িঁয়েছে ১৬.৭০ টাকায়। এটি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস।