বিশ্ববাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সোনার দাম। গত শুক্রবার সোনার দাম বেড়ে প্রতি আউন্স হয় দুই হাজার ৩৫০ ডলার, যা গত ১৯ এপ্রিলের পর থেকে সর্বোচ্চ দাম। এক সপ্তাহে মূল্যবান এ ধাতুর দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ। বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকস জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ডাটা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ফেডারেল রিজার্ভ অচিরেই সুদের হার কমাতে যাচ্ছে।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই ডাটায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে বিপুলসংখ্যক বেকার ভাতার আবেদন বেড়েছে। এতে কর্মসংস্থানের দুর্বল অবস্থাই বোঝা যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মসংস্থান বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার কমাতে পারে এমন সম্ভাবনা জোরালো হচ্ছে। তাই বিনিয়োগকারীরা ডলার থেকে সরে নিরাপদ হিসেবে সোনায় বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েল-হামাস সংঘাত শুরুর পর সোনার দাম প্রায় ৬০০ ডলার বেড়েছে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের বিশ্লেষক হ্যারি ডেম্পসির মতে, সোনার দামের এই উত্থানকে ক্রিপ্টোকারেন্সির উত্থানের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিশ্বের আর্থিক পরিস্থিতি এখন যেদিকে যাচ্ছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনাকেই বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রতি ১০০ দিনে এক লাখ কোটি (এক ট্রিলিয়ন) ডলার সরকারি ঋণ বাড়ছে।
ফার্স্ট ইগল ইনভেস্টমেন্টের ম্যাক্স বেলমন্ট বলছেন, মার্কিন সরকারের আর্থিক পরিস্থিতি টেকসই হচ্ছে না বলে উদ্বেগ আছে। আর সে কারণে সোনার বাজার বেশ রমরমা।
যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডে বিনিয়োগ করে এখন উঁচু হারে সুদ পাওয়া যাচ্ছে। ডলারও এই মুহূর্তের দারুণ চাঙা। ঠিক এই পরিস্থিতিতে সোনার দাম কম হওয়ার কথা।
কিন্তু ঠিক উল্টোটিই ঘটছে। সোনার বাজার রীতিমতো জমজমাট।
সোনার দাম যখন কমার কথা, তখন এর দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ বাজারের বড় রকমের পরিবর্তন। পশ্চিমা নয় এমন দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখছে। তারা বিপুল পরিমাণে সোনা কিনছে এবং এর ফলেই সোনার বাজার রীতিমতো ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক, অর্থাত্ জানুয়ারি-মার্চ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২৯০ টন সোনা কিনেছে। সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ৩০ টন। এ সময়ে সোনা কেনার দৌড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা কিনেছে ২৭ টন।
চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এখন সোনার মজুদ প্রায় দুই হাজার ২৬২ টন। ২০২২ সালের অক্টোবরের পর থেকে তাদের সোনার মজুদ বেড়েছে ১৬ শতাংশ। মার্চ মাসেও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা কিনেছে। ফলে এ নিয়ে টানা ১৭ মাস ধরে তারা সোনা কিনে চলেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মার্কিন সম্পদ বা বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। এসব দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের একটি অংশ মার্কিন বন্ডে বিনিয়োগ করে। ১৯৯৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের ৭১ শতাংশই ছিল মার্কিন ট্রেজারি বন্ড। ২০২০ সালে এই হার কমে ৫৯ শতাংশ হয়েছে।
মূলত রাশিয়ার বিপদ থেকে চীন শিক্ষা নেওয়ার কারণে এটা ঘটেছে। যুদ্ধকালীন যেকোনো সময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে নিজেদের সম্পদ নিরাপদে রাখতে বেইজিং মস্কোর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছে। ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা জোট রাশিয়ার ওপর নানা রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার একটি ছিল পশ্চিমে থাকা রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করা। জি৭ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার যে আর্থিক সম্পদ জব্দ করেছে, তার মূল্যমানই ৩০ হাজার কোটি ডলার।
তবে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে কেনার মতো বিপুল সোনা বিশ্বে নেই। অর্থাত্ বিশ্বে এত সোনা নেই যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ডলার বাদ দিয়ে শুধু মূল্যবান এই ধাতুতে তাদের নিজস্ব সম্পদের মজুদ রাখবে। তবে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় ডলারের আধিপত্যের অবসানের যে কথা বলা হচ্ছে, সেই বাস্তবতা যে খুব বেশি দূরে নেই, সেটা হয়তো এখন বলা যায়। সূত্র : ট্রেডিং ইকোনমিকস, রয়টার্স