দেশের পুঁজিবাজারে মূল্যসূচকের পতনের পেছনে নতুন কৌশলে কারসাজি করছে একদল দুষ্ট চক্র। তাদের হাতে থাকা কোম্পানিগুলোর শেয়ার ইচ্ছাকৃতভাবে এক বিও হিসাব থেকে লোকসানে বিক্রি করে অন্য নামের বিও হিসাব থেকে নিজেই ক্রয় করেন। ফলে বাজারে অস্থিরতা বাড়িয়ে আবার সেসব শেয়ার আরও কম দামে কিনে নেয় এসব চক্র। এতে মূল্যসূচকের পতনে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের পাশাপাশি কম দামে বিক্রিত শেয়ার কিনে তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করে তুলছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সার্ভেইল্যান্স টিমের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিএসইসি সূত্র জানায়, এসব কারসাজিতে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। এসব কারসাজির সাথে জড়িত ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে চিহ্নিত করে যোগ্য বিনিয়োগকারী হিসেবে আইপিও কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একইসঙ্গে যেসব ব্যক্তি এসব কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদেরকে জরিমানার আওতায় নিয়ে আসা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব কারসাজির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রমাণিত হলে সেসব প্রতিষ্ঠানের (ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক) সনদ নবায়ন স্থগিতসহ শিগগরই কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে।
বিএসইসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থসংবাদকে বলেন, একটি বড় মূলধনী কোম্পানির শেয়ার ৩৫০ টাকায় লেনদেন শুরু হয়। দুষ্ট চক্রের হাতে থাকা এই কোম্পানির শেয়ার তারা একটি বিও থেকে লোকসানে বিক্রি করে একই সুবিধাভুগী ব্যক্তির অন্য নামে আরেকটি বিও হিসাবে কম দামে শেয়ার ক্রয় করে। ফলে পুঁজিবাজারের মূল্যসূচকে বড় প্রভাব পড়ে। বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখে ওই কোম্পানির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের হাতে থাকা শেয়ার আরও কম দামে বিক্রি করে দেয়। এই সুযোগটাই লুফে নেয় সূচকের পতনের নেপথ্যে নতুন কারসাজি চক্র। তারা বাজারে আতঙ্ক সৃষ্টি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার আরও কম দামে কিনে মুনাফা লাভের জন্য এ ফন্দি আঁটছে। ফলে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় মূলধনী কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামে নেতিবাচক প্রভাব অন্যান্য কোম্পানির শেয়ারের দামেও পড়ে। এসব কোম্পানির শেয়ারদর সামান্য কমলেও সূচকে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যেমন আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি কম দামে শেয়ার বিক্রির চাপে লাগাতার পতন কাটিয়ে উঠতে পারছে না দেশের শেয়ারবাজার। তবে বাজারে তারল্য প্রবাহ কম থাকায় কোনভাবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না দেশের শেয়ারবাজার। এ অবস্থায় বাজারে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। সাধারণত পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা দুই ভাবে বিনিয়োগ করে থাকেন। একটি শ্রেণি নিজেদের জমানো টাকা বিনিয়োগ করে। আরেক শ্রেণি নিজেদের বিনিয়োগের পাশাপাশি শেয়ার জিম্মায় রেখে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে, যা ‘মার্জিন লোন’ নামে পরিচিতি। এ ধরনের ঋণ নিয়ে যাঁরা বিনিয়োগ করেন, তাঁদের শেয়ারের দাম একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নামলেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঋণের সমপরিমাণ শেয়ার বিক্রি করে দেয়। শেয়ারবাজারে এ ধরনের বিক্রিকে বলা হয় ফোর্সড সেল বা জোরপূর্বক বিক্রি। শেয়ারবাজারে যত পতনের ধারা বাড়ছে, ফোসর্ড সেলের চাপ তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজের অ্যানালাইসিস পোর্টাল সূত্র মতে, গত বৃহস্পতিবার সূচকের পতনের নেপথ্যে ভূমিকায় থাকা কোম্পানিগুলো হলো- বিকন ফার্মা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ন্যাশনাল ব্যাংক, রেনাটা, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্রাক ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং পূবালী ব্যাংক পিএলসি। এসব কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর কমার কারণে সবশেষ কার্যদিবসে ডিএসইর সূচক কমেছে ২৭ পয়েন্টের বেশি।
বৃহস্পতিবার ডিএসইর সূচক পতনের শীর্ষ ভূমিকায় ছিল বিকন ফার্মা। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ৭ টাকা ৯০ পয়সা। শেয়ারের দাম স্বাভাবিক চোখে খুব একটা না কমলেও কোম্পানিটির কারণে ডিএসইর সূচক কমেছে ৫ দশমিক ১৮ পয়েন্ট। এদিন ডিএসইর সূচক পতনের দ্বিতীয় ভূমিকায় ছিল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো। কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছিলো ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বা ১ শতাংশের একটু বেশি। এতেই ডিএসইর সূচক কমেছে ৩ দশমিক ৭৭ পয়েন্ট।
একইভাবে গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর সূচক কমায় ন্যাশনাল ব্যাংক ৩ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট, রেনাটা ৩ দশমিক ২৯ পয়েন্ট, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ২ দশমিক ৩৫ পয়েন্ট, ব্র্যাক ব্যাংক ২ দশমিক ০৪ পয়েন্ট, উত্তরা ব্যাংক ১ দশমিক ৯২ পয়েন্ট, লাফার্জাহোলসিম বাংলাদেশ ১ দশমিক ৭৬ পয়েন্ট, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ১ দশমিক ৭১ পয়েন্ট এবং পূবালী ব্যাংক পিএলসি ১ দশমিক ৬৬ পয়েন্ট ভূমিকা রেখেছে। বড় মূলধনী প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিকন ফার্মা, বিএটিবিসি, অলিম্পিক এবং রেনাটার শেয়ারদর খুব একটা না কমলেও বৃহস্পতিবার শুধু এই চার কোম্পানির কারণে পুঁজিবাজারের মূল্যসূচক কমেছে ১৪ দশমিক ৬০ পয়েন্ট।
ডিএসই সূত্রে মতে, গত ১১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে শেয়ারবাজারে টানা দরপতনে লেনদেন শেষ হচ্ছে। এতে সবশেষ ৪২ কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসইর) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৭৬০ পয়েন্টের বেশি, হারিয়েছে বড় অঙ্কের বাজার মূলধনও। গেল ১১ ফেব্রুয়ারি সূচক বছরের সর্বোচ্চ অবস্থান ৬ হাজার ৪৪৭ দশমিক ০৭ পয়েন্টে ছিল। যা গত বৃহস্পতিবার তথা সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ৫ হাজার ৬৮৬ দশমিক ৬৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে। এ হিসাবে প্রায় তিন মাস বা ৪২ কার্যদিবসে সূচক কমেছে ৭৬০ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট। এ সময়ে ৩১ কার্যদিবসই সূচকের পতন হয়েছে। আর বাকি মাত্র ১১ কার্যদিবস সূচক নামমাত্র বেড়েছে। তবে ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে টানা চার কার্যদিবসে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েও হতাশ করে বিনিয়োগকারীদের। ঈদের ছুটি শেষে টানা চার কার্যদিবসেই সূচকের পতন হয়েছে। এতে বাজারের পতন আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, গত ১১ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকার। তবে গত বৃহস্পতিবার তা নেমে আসে ৭ লাখ ০৬ হাজার ৩২৫ কোটি টাকায়। এ হিসাবে গত ৪২ কার্যদিবসে বাজার মূলধন কমেছে ৬৯ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। এদিকে সপ্তাহের শেষ কর্যদিবসে (১৮ এপ্রিল) প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ৭৭ পয়েন্ট। সূচকের এমন পতনের নেপথ্যে ভূমিকায় ছিল ১০ কোম্পানির শেয়ার।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে দরপতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফ্লোর প্রাইস এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে কোনো শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড বিএসইসির বেঁধে দেয়া দামের নিচে নামতে পারে না। দেড় বছর ধরে পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা আরোপিত ছিল। তাতে পুঁজিবাজারে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসে। কমে যায় লেনদেন। এমন এক পরিস্থিতিতে গত ২১ জানুয়ারি প্রথম দফায় ৩৫টি বাদে বাকি সব প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় ২৩ জানুয়ারি তুলে নেয়া হয় আরও ২৩ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস। সর্বশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি আরও ৬ কোম্পানির ওপর থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।