ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বেসরামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগেই নিলামে তুলছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৮টি উড়োজাহাজ। দীর্ঘ এক যুগ ধরে প্রতিষ্ঠানটির উড়োজাহাজগুলো বিমানবন্দরের পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সবগুলো উড়োজাহাজই এখন অকেজো। চাইলেই আর উড়তে পারবে না। আর উড়তে গেলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে পার্কিং ও সারচার্জ বাবদ দিতে হবে শত শত কোটি টাকা।
বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, কোনোটার শরীরে কয়েক স্তরে জমেছে ময়লা, কোনোটার যন্ত্রাংশ ভেঙে পড়ছে। ডানায় মাটি, ধূলা-ময়লার সংস্পর্শে কোনোটাতে জন্মেছে আগাছা। একসময় আকাশপথে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুট দাপিয়ে বেড়ানো উড়োজাহাজগুলো এখন নির্জীব। পরিত্যক্ত অবস্থায় চূড়ান্ত ক্ষয়ের প্রহর গুনছে। এয়ারলাইন্সটির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর খোঁজ নেই। পরিচালনা পর্ষদ কিংবা মালিকপক্ষের দেখা মেলাও ভার। অকেজো এসব উড়োজাহাজ সরিয়ে নিতে মালিকপক্ষকে বারবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পার্কিং ও সারচার্জ জমা দেওয়ার ভয়ে সরিয়ে নেয়নি কেউ।
গত ১১ বছরে এই ৮টি উড়োজাহাজের পার্কিং ও সারচার্জ বাবদ বকেয়া ৩শ ৫৫ কোটি টাকা। তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ ২০১৬ সাল থেকে। এখন এসব এয়ারলাইন্স থেকে পাওনা টাকা আদায়ে উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রির সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বেবিচক।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রির জন্য যে যে ধাপ রয়েছে, সেগুলো শেষ। আর এসব উড়োজাহাজ যে এখন উড়তে পারবে না, এই বিষয়ে টেকনিক্যাল মিটিং করেছি। আমাদের জব্দ তালিকাও করা হয়েছে। পাশাপাশি বেবিচক চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। কারণ, এসব উড়োজাহাজ থেকে যে আমাদের রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়নি তা জানানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের শেষ দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন কার্গো এরিয়াতে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। এজন্য প্রচুর জায়গা দরকার। তাই তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগেই যাতে এ উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রি করতে পারি, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছে।’
২০০৭ সালে দেশে ফ্লাইট অপারেশন শুরু করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। তবে কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই ২০১৬ সালে ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে তাদের বহরে থাকা ৮টি উড়োজাহাজ বিমানবন্দরে পড়ে রয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত ইউনাইটেড থেকে সারচার্জসহ অন্য খরচ বাবদ ওই পরিমাণ টাকা পাওনা রয়েছে বেবিচকের। গত কয়েক বছর ধরে পাওনা আদায়ে বারবার চিঠি দিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ আদায় করতে পারেনি বেবিচক।
চলতি বছরের শেষ দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন কার্গো এরিয়াতে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। এজন্য প্রচুর জায়গা দরকার। তাই তৃতীয় টার্মিনাল চালুর আগেই যাতে এই উড়োজাহাজগুলো নিলামে বিক্রি করতে পারি, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কোম্পানির পর্ষদ ভেঙে নতুন সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক বসিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই সাতজনের মধ্যে অ্যাভিয়েশন ও ভ্রমণ বিষয়ক সাময়িকী ‘বাংলাদেশ মনিটর’ সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলমকে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়। গত বছরের ৩ জানুয়ারি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে সাত বছরের (২০১৬-২০২২) বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। এজিএমে যত দ্রুত সম্ভব এয়ারলাইন্সটিকে অপারেশনে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন স্বতন্ত্র পরিচালকদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের সদস্যরা।
তখন তারা বলেছিলেন, প্রথম ধাপে কার্গো অপারেশন, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে (২০২৬) কমার্শিয়াল ফ্লাইট শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু গত এক বছর চার মাসে এই বিষয়ে তাদের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে পরিচালনা পর্ষদ।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালানা পর্ষদের সদস্যরা বলছেন, ইউনাইটেডের কার্যক্রম ফের শুরু করতে হলে এয়ার অপারেটিং সার্টিফিকেট (এওসি) নবায়ন করতে হবে। কিন্তু বকেয়া পরিশোধ না করায় এওসি দিচ্ছে না বেবিচক।
বেবিচক সূত্র জানায়, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের পাওনা ৩শ ৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল দেনা ৫৫ কোটির মতো, বাকি টাকা সারচার্জ। এই টাকা পরিশোধ না করলে এওসি ইস্যু করা যাবে না। যদিও ইউনাইটেডের পক্ষ থেকে সারচার্জ মওকুফের অনুরোধ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় তা নাকচ করে দিয়েছে। ফলে ইউনাইটেডের জন্য আর কোনো দরজা খোলা রইলো না।
এসব বিষয়ে জানতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমকেকে বলেছিলেন, ‘আমরা ৩শ কোটি টাকা সারচার্জ মওকুফের জন্য আবেদন করেছিলাম। আর মূল বকেয়া ৫৫ কোটি টাকা এয়ারলাইন্স চালু হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে দেবো বলেছিলাম। এ প্রস্তাবে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দেয়নি। ফলে এয়ারলাইন্স পরিচালনায় এওসি নবায়ন করতে পারিনি।’