বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রকল্পে অর্থায়ন উৎসাহিত করে আসছে। ফলে দেশের ব্যাংক ও ব্যাংক–বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) এখন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রকল্পগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বদৌলতে গত এক বছরে টেকসই প্রকল্পে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় আড়াই গুণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ পরিবেশবান্ধব খাতে বিতরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। সেই সঙ্গে মোট ঋণের ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে দিতে বলেছে। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্প ইত্যাদি। টেকসই অর্থায়নের মধ্যে রয়েছে পরিবেশবান্ধব খাতে যেকোনো ধরনের অর্থায়ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘টেকসই খাতে অর্থায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে টেকসই খাতে ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা, যা ছিল ব্যাংকগুলোর দেওয়া মোট মেয়াদি ঋণের ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সাল শেষে এই খাতে ব্যাংক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট মেয়াদি ঋণের ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০২২ সালে টেকসই খাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা তাদের দেওয়া মোট মেয়াদি ঋণের ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষে এই খাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা মোট মেয়াদি ঋণের ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
সারা বিশ্বে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। সে জন্য কার্বন নিঃসরণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে ঝুঁকছে বিভিন্ন দেশ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। এদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ২০০টির বেশি। এই অবস্থায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই অর্থায়নের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম শুরু করেছে। তারই অংশ হিসেবে অনেক ব্যাংক তাদের শাখা ও এটিএমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক তো কাগজের ব্যবহারও কমিয়ে আনছে। টেকসই অর্থায়নের ক্ষেত্রে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে বা হবে এমন প্রকল্পগুলোকে প্রধান দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও ব্যাংক–বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এনবিএফআই) উৎসাহিত করে আসছে। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি চার বছর বছর ধরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাসটেইনেবল রেটিং বা টেকসই মান প্রকাশ করছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই উদ্যোগ নিয়েছে। মূলত পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে এই মান যাচাই করা হয়। সূচকগুলো হলো টেকসই অর্থায়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম, পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন, টেকসই কোর ব্যাংকিং সূচক এবং ব্যাংকিং সেবার পরিধি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্য অর্জনকারী শীর্ষ ব্যাংকগুলোর তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক শীর্ষে রয়েছে। শীর্ষ দশের বাকি নয়টি হলো ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), উত্তরা ব্যাংক ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)।
টেকসই অর্থায়নের লক্ষ্য অর্জনকারী শীর্ষ পাঁচ আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো সিভিসি ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স।
এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষে থাকার কারণ সম্পর্কে এটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে আমরা পরিবেশবান্ধব ও টেকসই খাতে অর্থায়ন করে যাচ্ছি। অনেক কারখানা এখন পরিবেশবান্ধবে রূপান্তরিত হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব কারখানাও হচ্ছে। আমরা এসব কারখানায় অর্থায়ন করে যাচ্ছি। এ জন্য আমরা ঋণ প্রদানে শীর্ষে উঠে এসেছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, টেকসই অর্থায়ন নিয়েছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ লাখ ৫১ হাজার ১৭ জন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৬১৫ জনই হলেন নারী উদ্যোক্তা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে টেকসই অর্থায়নের গ্রাহক সংখ্যা ৩ হাজার ৯৭৫ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৯ জন নারী, যা মোট গ্রাহকের ৫১ শতাংশ।
টেকসই ও পরিবেশবান্ধব ঋণের ৪৩ শতাংশ কৃষিভিত্তিক প্রকল্পে, ৩৬ শতাংশ সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের নামে ও ১৪ শতাংশ পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে গেছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর ৬১২টি শাখা ও ৭১৭টি এটিএমে এখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে।