নিউ ইয়র্কে অবস্থিত স্কারসডেল মেডিক্যাল গ্রুপের সংক্রামক রোগের চিকিৎসক সিয়ান জে. ক্লুনানের মতে, ‘সংক্রমণ ও হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে যোগসূত্রের দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, সংক্রমণ শরীরকে চাপে ফেলে। এই চাপ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি উচ্চ করে। দ্বিতীয়ত, সংক্রমণ শরীরে প্রদাহ তৈরি করে। এটা ধমনীতে প্লেক গঠনের প্রক্রিয়াকে আরো জোরালো করে।’ এখানে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে এমনকিছু সংক্রমণের তালিকা দেয়া হলো।
ফ্লু: দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ২০১৮ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ফ্লু রোগীর প্রথম কিছুদিন হার্ট অ্যাটাকের বাড়তি ঝুঁকি ছিল। কিন্তু যারা ফ্লু ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের বাড়তি ঝুঁকি ছিল না। তাই সম্ভব হলে ফ্লু শট নিন।
ব্রনকাইটিস: ব্রনকাইটিস হলো ফুসফুসের ভেতরের স্তরের প্রদাহ, যা প্রায়সময় সংক্রমণ দ্বারা হয়ে থাকে। এটা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শ্বাসনালীতে সংক্রমণ শনাক্তের প্রথম তিনদিন হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি পাঁচগুণ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি তিনগুণ বেশি থাকে। সময় অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি কমতে থাকে ও সংক্রমণটি থেকে নিরাময়ের তিন মাসের মধ্যে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসে।
নিউমোনিয়া: আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণ হলো নিউমোনিয়া। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব প্রিভেনটিভ কার্ডিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণায় পাওয়া গেছে- ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে যাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, তাদের সংক্রমণের বছরটিতে হার্ট ও রক্তনালীর ঝুঁকি ৬ গুণ বেশি ছিল। পরবর্তী দুই ও তিন বছরে ঝুঁকি আরো বেড়েছে। পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়তি ঝুঁকি ছিল।
শ্বাসতন্ত্রের অন্য সংক্রমণ: যুক্তরাজ্যের অ্যাস্টন মেডিক্যাল স্কুলের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় জানা গেছে, শ্বাসতন্ত্রের যেকোনো সংক্রমণে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে ও ধমনীতে প্লেক জনিত স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে যতটুকু ঝুঁকি বাড়ে তার চেয়েও বেশি ঝুঁকি বাড়াতে পারে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ। একটি নতুন শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণ হচ্ছে কোভিড-১৯।
মূত্রনালীর সংক্রমণ: শুনতে অবাক লাগলেও এটা সত্য যে, মূত্রনালীর সংক্রমণ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। জার্নাল অব দ্য আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশানের গবেষণা মতে, করোনারি হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো মূত্রনালীর সংক্রমণ।হৃদরোগে আক্রান্ত ৩৭ শতাংশ লোকের হার্ট অ্যাটাকের তিন মাস পূর্বে মূত্রনালীর সংক্রমণ ছিল। সার্কুলেশনে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, মূত্রনালীতে সংক্রমণের ২৯ থেকে ৯১ দিনের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের বর্ধিত ঝুঁকি রয়েছে।
সেপসিস: সেপসিস (রক্ত সংক্রমণ) হচ্ছে শরীরে বিদ্যমান সংক্রমণের প্রতি ইমিউন সিস্টেমের এক্সট্রিম রেসপন্স। সেপসিসে হার্ট ও সংবহনতন্ত্র অকার্যকর হতে শুরু করে এবং রক্তচাপ দ্রুত কমে যায়। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহে রক্ত চলাচল ধীর হয়ে যায়। রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার কারণে অঙ্গগুলো অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। যারা জীবন-হুমকির দশা সেপসিস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি খুবই উচ্চ। এর সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে সিস্টেমিক প্রদাহ। সিস্টেমিক প্রদাহে প্লেক ভেঙে রক্ত জমাট বেধে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সেপসিস নিরাময়ের পরও দীর্ঘসময় প্রদাহ থেকে যায়।
ক্লামাইডিয়া: গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত যৌনবাহিত রোগ ক্লামাইডিয়া তরুণদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের এ গবেষণার প্রধান গবেষক বলেন, ‘এটা একটি প্রাথমিক গবেষণা।এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে আরো গবেষণা করতে হবে।’
এইচআইভি: ডা. ক্লুনান বলেন, ‘এটা এখন আর অজানা নয় যে, এইচআইভিতে আক্রান্ত লোকেরা হার্ট অ্যাটাকের বর্ধিত ঝুঁকিতে থাকেন। এর জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহকে দায়ী মনে করা হয়।’ ভাইরাসটি ইমিউন সিস্টেমকে দীর্ঘমেয়াদে সক্রিয় রাখে বলে শরীরে সাইটোকিনের পরিমাণ বেড়ে যায় ও ধমনীতে ড্যামেজ হয়। কিছু পুরোনো এইচআইভি ওষুধও হার্টকে ঝুঁকিতে রাখে। কিন্তু গবেষকরা আশাবাদী যে, নতুন ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হবে।
মুখের সংক্রমণ: মুখের ভেতরের কিছু ব্যাকটেরিয়া হার্টকে ড্যামেজ করতে পারে। দাঁতের সংক্রমণ, মাড়ির ফোলা ও মাড়িতে পুঁজের থলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক গবেষণায় দাঁত ও মাড়ির রোগের সঙ্গে হৃদরোগের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। এটা প্রতিরোধ করতে প্রতিদিন দু’বার দাঁত ব্রাশ ও একবার ফ্লস করুন। বছরে দু’বার ক্লিনিং করতে ডেন্টিস্টের কাছে যান ও মুখে সংক্রমণের লক্ষণ দেখলে দ্রুত পদক্ষেপ নিন।