প্রায় দেড় যুগ ধরে এক টাকায় ইফতারি বিক্রি করছে খুলনার ইকবাল হোটেল। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামের এই সময়েও নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এ ব্যবস্থা চালু রেখেছে ১২ বন্ধু। তাঁরা ভিন্নধর্মাবলম্বী হলেও ভর্তুকিতে সবার সমান অংশগ্রহণ। ধর্মীয় সম্প্রীতি আর বন্ধুত্বের এমন নজির দেখে এসেছেন উত্তম মণ্ডল
দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা কালীবাড়ি বাজারে ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেন। অকৃতদার মানুষটি দেড় যুগ আগে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কম দামে ইফতারসামগ্রী বিক্রি শুরু করেন। ইকবালের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছেন আরও ১১ জন। সবাই স্থানীয় বাজারে ছোটখাটো ব্যবসা করেন।
ঐতিহ্যবাহী বা বিশেষ কোনো আইটেম না, রমজান মাসে ইকবাল হোটেলে বিক্রি হয় পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপের মতো সাধারণ ইফতারি। তারপরও প্রতিদিনই এ সময় হোটেলটার সামনে দীর্ঘ লাইন পড়ে। কারণ, যে পদই নেওয়া হোক, দাম মাত্র এক টাকা।
দেড় যুগ আগে ইফতারসামগ্রীর যা দাম ছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার পরও এখনো তা-ই আছে। তবে এ জন্য দিতে হয় ভর্তুকি। চানরাতে তাঁরা একটা হিসাব করেন। যে ঘাটতি থাকে, ১২ জন মিলে সেটা দিয়ে দেন। আর ইফতারসামগ্রী তৈরি ও বিক্রির প্রক্রিয়ায় সবাই মিলে শ্রম দেন। ১২ জনের দলে মুসলমানদের বাইরে আছেন তিনজন হিন্দু আর একজন খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষ।
ইফতারসামগ্রী বিক্রির সময় ক্যাশের দায়িত্বে থাকেন গোবিন্দ কুমার দাস। দোকানভাড়ার আয় ছাড়াও তাঁর আছে মৌসুমি ফলের ব্যবসা। চার বছর ধরে ইকবালের এই উদ্যোগের সঙ্গে তিনি শামিল। হিসাব-নিকাশ ভালো বোঝায় ক্যাশ সামলানোর দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে। গোবিন্দ বলেন, ‘সব ধর্মেই তো মানুষের সেবার কথা বলা আছে। এই উদ্যোগের অংশ হতে পেরে ভালো লাগে। আমার বাড়িতে কোনো উৎসব কিংবা বিপদ-আপদ হলে আশপাশের মুসলমান ভাইয়েরাই তো সহায়তা করেন।’
বাজার করা থেকে শুরু করে ইফতারসামগ্রী তৈরি ও বিক্রিতে সার্বক্ষণিক সহায়তা করেন ৬৭ বছর বয়সী শিবুপদ দে। বছর দুয়েক হয় ট্রাকচালকের পেশা ছেড়েছেন। তবে যখন ট্রাকচালক ছিলেন, তখনো রমজানের এই সময়টায় ইকবালের পাশে থাকার জন্য ট্রাক চালানো বন্ধ রাখতেন।
শিবুপদ বলেন, ‘আমাদের তো অর্থবিত্ত অত বেশি নাই যে মানুষের জন্য বড় করে কিছু করব। তবে শ্রম আর সামান্য অর্থ দিয়ে যদি মানুষের কিছুটা উপকার হয় তাহলেও তো তৃপ্তি। কম টাকায় ইফতারি পেয়ে গরিব মানুষেরা খুব খুশি হয়। সেই খুশির আনন্দ আমাদের মনেও লাগে। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে যদি সামান্যতম উপকারে না আসতে পারি, তাহলে আর লাভ কী হলো!’
সম্প্রীতির কথা বলতে গিয়ে শিবুপদ দে জানান, তাঁদের গ্রামের একটা ঐতিহ্য ছিল। হিন্দু–মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। একসঙ্গেই তাঁদের বেড়ে ওঠা। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা যখন যুবক ছিলাম, পূজার জন্য আলাদা মন্দির ছিল না। বাঁশ দিয়ে মণ্ডপ করা হতো। হিন্দু–মুসলমান একসঙ্গে বাঁশ দিয়ে সেগুলো করতাম। সুনামটা এখনো আছে। তবে হালে বিভিন্ন জেলার লোক আসার পর সম্প্রীতির সেই পরিবেশে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।’
নিরঞ্জন বাড়ৈ খ্রিষ্টধর্মের মানুষ। ইকবালের দোকানের সামনেই তাঁর আসবাবের ছোট দোকান। সকাল থেকেই ইফতারসামগ্রী তৈরির প্রক্রিয়ার জড়িত থাকেন। তবে দুপুরের পর থেকে বিক্রি শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজের দোকান বন্ধ রেখে ইফতারসামগ্রী বিক্রিতে সহায়তা করেন। নিরঞ্জনের ভাষ্য, ‘যেকোনো ভালো কাজে শামিল হতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। মানবসেবাই তো বড় সেবা। সেটাই মাথায় রাখি। মনে একটা তৃপ্তি পাই।’
১২ বন্ধুর অন্যরা হলেন রায়হান শাহ, মো. আমিন, মো. রুবেল, মনিরুল ইসলাম, আবদুল খালেক, হাফিজুর রহমান শিকদার, কায়সার রিজভী ও বিষ্ণুপদ দে। ভোর থেকেই শুরু হয় ইকবালদের কর্মযজ্ঞ। এ সময় কেউ কেউ শুধু সকালে নিজ নিজ ব্যবসা চালালেও দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই একসঙ্গে কাজ করেন। প্রতিদিন বিভিন্ন পদ মিলিয়ে ৭ হাজারের কিছু বেশি ইফতারসামগ্রী এক টাকায় বিক্রি করেন তাঁরা।