অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্চাচারিতার কারণে দেশের ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যা এরই মধ্যে সবল ব্যাংককে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ’ প্রতিবেদনে সব মিলিয়ে ৩৮টি ব্যাংককে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯টিই লাল তালিকায় চলে গেছে।
তবে নিজেদের করা এই প্রতিবেদন নিয়ে এখন ভিন্ন সুরে কথা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রের দাবি, প্রতিবেদনটি গবেষণার জন্য করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিবেদন নয়। এটি ব্যাংকগুলোর প্রকৃত স্বাস্থ্যের নির্দেশক নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা তুলে ধরে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যম খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ৯ ব্যাংকে লাল বাতি জ্বলছে, আরও ১২টির অবস্থা ‘খুব খারাপ’। আরও তিনটি হলুদ তালিকায় থাকলেও সেগুলোর অবস্থা লাল তালিকাভুক্ত ব্যাংকের কাছাকাছি। আর স্বাস্থ্য ভালো আছে মাত্র ১৬টি ব্যাংকের।
গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক হেলথ ইনডেক্স অ্যান্ড হিট ম্যাপ শীর্ষক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে এসব প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, লাল তালিকায় চলে যাওয়া ব্যাংকগুলো হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। আর হলুদ তালিকায় থাকলেও লাল তালিকাভুক্তগুলোর মতোই নাজুক ৩ ব্যাংক হলো বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), সোনালী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
এর প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। দুর্বল ব্যাংকের এই তালিকা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকটি গণমাধ্যমে দুর্বল ও সবল ব্যাংকের তালিকা প্রকাশ হয়েছে। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদন নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি বিভাগ তাদের নিজস্ব কিছু তথ্য গবেষণা বা বিশ্লেষণের জন্য এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগ নানা কম্পোনেন্ট নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট করে। রেগুলার ফিন্যান্সিয়াল রিস্ক ম্যানেজমেন্টের জন্য এটা করা হয়। তবে এটা প্রকৃত হেলথ ইন্ডিকেটর নয়। তাই এটি দিয়ে কোনো ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক অবস্থা নির্ণয় বা তুলনা করা ঠিক হবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জানান, গত বছরের জুন থেকে অর্ধবার্ষিক আর্থিক কর্মক্ষমতার ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য ব্যাংকের স্বাস্থ্য সূচক তৈরি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগ। স্বাস্থ্য সূচক হিসেবে তৈরি করা ৫৪টি ব্যাংকের স্বাস্থ্য রেটিং করা হয়েছে। এতে ৯টি ব্যাংক ইতিমধ্যে রেড জোনে, ২৯টি ইয়েলো জোনে এবং ৩টি ব্যাংক রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ৮টি বিদেশি ও ৮টি দেশি ব্যাংক রয়েছে।
মেজবাউল হক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ (মার্জার) প্রসঙ্গে বলেন, পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী কোনো দুর্বল ব্যাংক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে একীভূত না হয়, তাহলে আগামী ডিসেম্বরের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের একীভূত করবে। ব্যাংকগুলোকে শ্রেণীকরণ করতে এরই মধ্যে একটা পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। এখানে চারটি ক্যাটাগরিতে ব্যাংকগুলোকে মূল্যায়ন করা হবে। চলতি বছরের ব্যালান্স সিটের ওপর ভিত্তি করে এটা করা হবে। যেটা কার্যকর হবে ২০২৫ সালের মে মাস থেকে।
এদিকে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হলে বিদেশ ভ্রমণ, ব্যবসার সনদ, রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না। পাশাপাশি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরকেএসসি) কাছে কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদির নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে সংস্থাটি। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকায় কারও নাম এলে ঋণ পরিশোধ করে তালিকা থেকে অব্যাহতির পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। আর যদি কোনো পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়ে পড়েন তবে তাঁর পরিচালক পদ বাতিল হবে।
কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি হওয়ার পর তালিকার বিরুদ্ধে আপিল না করলে বা আপিল করার পর নামঞ্জুর হলে তাঁকে দুই মাসের মধ্যে অর্থ পরিশোধের জন্য নোটিশ দিয়ে খেলাপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে।