দেশে কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না হলেও জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করছেন না বেশিরভাগ মানুষ। অন্যান্য স্থানের মতো স্বাস্থ্যবিধি পরিপালনে ভাটা পড়েছে প্রশাসনের প্রাণ কেন্দ্র সচিবালয়েও।
সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের একটি লিফটে (৬/৪ নম্বর) নোটিশ রয়েছে ‘স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তায় গায়ে গা না লাগিয়ে লিফট ব্যবহার করুন’। কেউ ‘না’ শব্দটি কলম দিয়ে কেটে দিয়েছে। এখন দাঁড়িয়েছে ‘স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তায় গায়ে গা লাগিয়ে লিফট ব্যবহার করুন’। বলতে গেলে এখন পরিস্থিতিও তা-ই দাঁড়িয়েছে।
লিফটগুলোতে বেশিরভাগ সময় গাদাগাদি করে ওঠা-নামা করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে জীবাণুনাশক টানেল বসানো হলেও সেগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ আছে। বেশিরভাগ টয়লেটেই কোনো সাবান নেই। মাস্ক ছাড়া লোকজনকে সচিবালয়ের ভেতরেও চলাচল করতে দেখা গেছে।
বুধবার সচিবালয় ঘুরে এ চিত্র দেখার পর আলাপ করলে কর্মকর্তারা জানান, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা ছাড়াও সচিবালয়ে অনেকের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কম। ঝুঁকি জেনেও গাদাগাদি করে লিফটে উঠছেন, সক্রিয় থাকলেও জীবাণুনাশক টানেলে প্রবেশ না করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরিস্থিতি অবনতির দিকে যেতে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। টানা ৬৬ দিনের ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে সরকারি অফিস খুলে দেয়া হয়, চালু হয় গণপরিবহন। সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস করতে পারবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেয়া হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ, অসুস্থ ও সন্তানসম্ভবা নারীদের অফিসে আসতে হবে না বলেও নির্দেশনায় জানানো হয়। পরে এই মাসের শুরুর দিকে নতুন নির্দেশনায় জানানো হয়, ঝুঁকিপূর্ণ, অসুস্থ ও সন্তানসম্ভবা নারী ছাড়া সবাইকে অফিসে আসতে হবে।
করোনায় বিধি-নিষেধ মানা সংক্রান্ত সর্বশেষ নির্দেশনার মেয়াদ গত ৩১ আগস্ট শেষ হয়। এ বিষয়ে নতুন চারটি নির্দেশনা জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিধি-নিষেধের মেয়াদ নতুন করে আর না বাড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ছাড়া সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে দেয়ার এটি সবশেষ পদক্ষেপ সরকারের। এর আগে গণপরিবহনে বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করে যাত্রী পূর্ণ করে গণপরিবহন চালাচলের অনুমতি দেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে ৭ নম্বর ভবনের ৮ম তলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের জীবাণুনাশক টানেল বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। এই ভবনের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের টানেলটিও অকার্যকর দেখা যায়।
এছাড়া ৬ নম্বর ভবনের নবম তলায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দুটি জীবাণুনাশক টানেলই কাজ করছে না। এই ভবনের তৃতীয় তলায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের টানেলটিও নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে।
টানেল কাজ না করার বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) দীপক চক্রবর্তী বলেন, ‘টানেল কখনো কাজ করে কখনো কাজ করে না, এভাবেই যাচ্ছে।’ তবে তিনি সপ্তম তলায় স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রবেশের আগে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা ও স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন। যদিও বুধবার দুপুরে স্থানীয় সরকার বিভাগ ঘুরে তেমন কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) সাকিউন নাহার বেগম বলেন, ‘যারা টানেল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন তারা বুধবার সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারেননি। তাই এটি বন্ধ রয়েছে। বৃহস্পতিবার তারা এসে ঠিক করে দেবেন।’
৬ নম্বর ভবনে ছয়টি লিফট রয়েছে। এই লিফটগুলোতে গাদাগাদি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উঠতে দেখা গেছে। বুধবার এই ভবনের পশ্চিম পাশের মাঝখানের লিফটে ১০-১১ জনের মতো উঠে যান। এখানে থাকা একজন নারী কর্মকর্তা লিফটম্যানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমাদের লিফটে কতজন উঠবে সেটা কী নির্ধারণ করে দেয়া নেই?’ লিফটম্যান বলেন, ‘না ম্যাডাম, সেটা বলা নাই। লোকজন উঠে গেলে কী করব বলুন!’
৬ নম্বর ভবনের ১৯ তলায় বসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি লিফটে ১২ জন নিয়ে উঠেছি। কেউ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না। কী ভয়ংকর অবস্থা বলুন।’
সচিবালয়ে প্রত্যেকটি ভবনের প্রত্যেকটি ফ্লোরে টয়লেট রয়েছে। কিন্তু বুধবার দু’একটি ছাড়া কোনো টয়লেটেই সাবান পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন ভবন, সিঁড়ি বা লিফটে ওঠার স্থানে স্যানিটাইজারের কন্টেইনার থাকলেও সেগুলোতে কোনো স্যানিটাইজার দেখা যায়নি। চার নম্বর ভবনের পশ্চিম পাশের লিফট, তিন নম্বর ভবনের লিফটের সামনে স্যানিটাইজারের কন্টেইনার থাকলেও স্যানিটাইজার পাওয়া যায়নি সেখানেও।
চার নম্বর ভবনের মাঝখান দিয়ে প্রবেশ স্থানের মুখে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন বসানো হয়েছে। কিন্তু সাবান রাখার স্থানে সাবান ছিল না।
৬ নম্বর ভবনের ১৯ তলায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ফ্লোরের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় ভিড় জমে গেছে। জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা শিক্ষক। ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া অনলাইন বদলি কার্যক্রমের জন্য তারা এসেছেন বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কিন্তু সচিবালয়ে প্রবেশের পাস বন্ধ থাকার পরও তারা কীভাবে সচিবালয়ে প্রবেশ করছেন, সেই বিষয়ে কেউ স্পষ্ট করে কিছু জানাতে পারেননি।
সচিবালয়ে স্বাস্থ্যবিধির শিথিলতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমরা দেখব। দেখে যা দরকার সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেব। তবে করোনার বিষয়ে মানুষের একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে মানুষের ইমিউনিটিও (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) কিছুটা বেড়ে গেছে। মানুষের মধ্যে বুঝ তৈরি হয়েছে যে, কীভাবে চললে ভালো হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবিধি মানা সংক্রান্ত যে নির্দেশিকা রয়েছে। সেটা এখনও আছে। পরিস্থিতি দেখে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’