ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা ইস্যুতে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে কেনার চেয়ে বেশি বিক্রি করেছেন। দীর্ঘদিন পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এবার শেয়ার কেনায় সক্রিয় হচ্ছেন। গত মার্চ মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছিল সামান্য। এপ্রিলেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ডিএসইর সূত্র মতে, গত এপ্রিল মাসে শেয়ারবাজারে মোট ১৮ কর্মদিবস লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১২ কর্মদিবস উত্থান আর ৬ কর্মদিবস পতন হয়েছে। সবমিলে মাসটিতে ১৮ লাখ ৭০ হাজার বিওধারী (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) বিনিয়োগকারীরা শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড এবং বন্ড কেনা-বেচা করেছেন ১০ হাজার ২৯৬ কোটি ২৯ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৪ টাকার।
বিএসইসির তথ্য মতে, ১০ হাজার ২৯৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীরা ১০ হাজার ১১৪ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৮৪৪ টাকার শেয়ার কেনা-বেচা করেছেন। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনা-বেচা করেছেন ১৮২ কোটি ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫১০ টাকার। মোট কেনা-বেচার তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন কম হলেও বাজারে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সিডিবিএলের তথ্য মতে, এপ্রিল মাসের শুরুতে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিওধারীর সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ৮টি। এই বিনিয়োগকারীরা ১৩১ কোটি ৪২ লাখ ২৭ হাজার ২৪০ টাকার শেয়ার কিনেছেন। তার বিপরীতে শেয়ার বিক্রি করেছেন ৫০ কোটি ৭৯ লাখ ৪ হাজার ২৭১ টাকা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব কোম্পানিতে সুশাসন আছে, মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) কম, বিনিয়োগ করলে লাভ নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে বিদেশিরা সেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। এখন বেশ কিছু ভালো কোম্পানির শেয়ার কম দামে বিক্রি হচ্ছে, তাই দেখে বিদেশিরা কিনছেন।
বিএসইসির দাবি, শেয়ারের প্রাইস আর্নিং (পিই) রেশিও ভালো, পাশাপাশি বর্তমান বাজার যে অবস্থায় রয়েছে তা থেকে ইনডেক্স আরও বাড়বে। এটি বুঝতে পেরে বিদেশিরা শেয়ারবাজারে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ১০ মিলিয়ন, ১৫ মিলিয়ন করে বাজারে বিনিয়োগ আসছে। আগামীতে আরও বড় বিনিয়োগ আসবে।
বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিভিন্ন দেশের রোড-শোতে এবং ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ ও শেয়ারবাজারে ভালো দিকগুলো তুলে ধরায় প্রবাসী ও বিদেশিদের বাংলাদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের বাজারে যেহেতু পিই রেশিও কম, মার্কেট আরও বড় হবে এবং এখান থেকে আরও বেশি রিটার্ন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, তাই বিদেশিরা বড় বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসা শুরু করেছেন। সামনে আরও বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন কারণে বিদেশিরা বর্তমানে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগমুখী হচ্ছেন। তার মধ্যে প্রথম কারণ হলো, দেশে টাকার অবমূল্যায়নের পর ডলারে বাজারে অস্থিরতা কমেছে। এখন ডলারের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল।
দ্বিতীয়ত, বাজারে শেয়ারের দাম কম। ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এখন বিনিয়োগ করলেই মুনাফা হবে।
তৃতীয়ত হচ্ছে, টাকার মান কমায় ডলারের বিপরীতে বেশি শেয়ার কিনতে পারছেন বিনিয়োগকারীরা। অর্থাৎ বিদেশিরা যখন দেখছেন মুনাফা তুলে নিয়ে যেতে পারবে তখনই বিনিয়োগ করছে।
এক ডলার পরিমাণ টাকার মূল্য ৮৪ থেকে ১১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে একদিকে শেয়ারবাজার থেকে কম দামে শেয়ার কিনতে পারছেন বিদেশিরা। অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়ায় একই ডলার দিয়ে বেশি ২৫ থেকে ৩০ টাকা মুনাফায় শেয়ার কিনছেন তারা। অর্থাৎ কম দামে বেশি শেয়ার কিনতে পারছেন। তাই তারা বেশি শেয়ার কিনছেন।
ডলারের তুলনায় টাকার মান কমাটা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয়, এই কারণে তারা বিনিয়োগ করছেন। এছাড়াও ফ্লোর প্রাইস উঠে গেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও ভালো হতো। তাহলে তারা আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারতো-এমনটাই বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বিদেশে বিনিয়োগের পরিসংখ্যান
চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতে দেশের শেয়ারবাজারে ৬৩ হাজার ৮টি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও ছিল। সেখান ১১৪টি বিও কমে মে ৩১ মার্চ দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৮৯৪টিতে।
ডিএসইতে এপ্রিল মাসে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেনের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ১৮২ কোটি টাকার শেয়ার কেনা-বেচা করেছেন। এর মধ্যে ১৩১ কোটি ৪২ লাখ টাকার শেয়ার কিনে বিক্রি করেছেন ৫০ কোটি ৭৯ লাখ ৪ হাজার ২৭১ টাকা।
ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছিল ১২ হাজার ১০৫ কোটি ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৬১২ টাকা। সে সময় বিদেশিদের শেয়ার কেনা-বেচা বাবদ লেনদেন হয়েছিল ৩০৮ কোটি ৯৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭২ টাকা। এই লেনদেনের মধ্যে ৬৪ কোটি ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮৯ টাকার শেয়ার কিনেছেন। বিপরীতে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছেন ২৪৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৬ হাজার ৭৮২ টাকার। অর্থাৎ ১৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৯৩ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন।
আগের বছর যেখানে ১৮০ কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ কমেছিল, এই বছর ৮০ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ এসেছে। যা বাজারের জন্য এই মুহূর্তে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
সূত্র মতে, চলতি বছরের মার্চ মাসে বিদেশিদের ৮৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এর মধ্যে শেয়ার কিনেছে ৪৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকার, তার বিপরীতে বিক্রি করেছে ৪২ কোটি ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৫৭ টাকা। ওই মাসেও নিট বিনিয়োগ এসেছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৩৬ হাজার ৭৫২ টাকা। সেই ধারাবাহিকতায় এপ্রিলে নিট বিনিয়োগ আর বাড়ল।
তবে তার আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে বিদেশিদের লেনদেন হয়েছিল ১৯২ কোটি টাকা। তার মধ্যে তারা ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছিল। বিপরীতে বিক্রি করেছিল ১০২ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭৬ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ ১২ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ নেগেটিভ ছিল।
তার আগের মাস অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বিদেশিরা ১৭৪ কোটি ৮৪ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৫ টাকার শেয়ার কেনা বেচা করেছিল। এর মধ্যে ২১ কোটি টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে বিক্রি করেছে ১৩৫ কোটি টাকার শেয়ার। নিট বিনিয়োগ নেগেটিভ ছিল।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদেশিরা মোট ১৩৭ কোটি ৬ লাখ ৫ হাজার ১৩৮ টাকার শেয়ার কেনা-বেচা করেছিল। ৩৬ কোটি ১ লাখ টাকার শেয়ার কেনার বিপরীতে ১০১ কোটি ৪ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করেছিলেন বিদেশিরা।
২০২২ নভেম্বর মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ২৬২ কোটি ৬৩ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৬ টাকার শেয়ার কেনা বেচা করেছিল। তার মধ্যে ১৯১ কোটি ৮৯ লাখ ১৭ হাজার ৮৭৩ টাকার শেয়ার কিনেছে, বিপরীতে বিক্রি করেছেন ৭০ কোটি ৭৪ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪২ টাকা। অর্থাৎ সে মাসে নিট বিনিয়োগ ছিল ১২১ কোটি ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৩১ টাকার। সে হিসেবে চার মাস পর আবার শেয়ার কেনার প্রবণতা বেড়েছে।