সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবসেই দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) পতন দেখলেন বিনিয়োগকারীরা। রোববার ৩৫.৯৯ পয়েন্টের পর গতকাল সোমবার ডিএসইএক্স কমেছে ৬৫.২৬ পয়েন্ট। অর্থাৎ দুদিনেই সূচক কমেছে ১০১.২৫ পয়েন্ট। আগের সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে চারদিনই সূচকের পতন দেখা গেছে। ফলে আগের সপ্তাহের শেষ দুদিনসহ টানা চার দিনে কমেছে ১০৬.২৮ পয়েন্ট।
বছরের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী পুঁজিবাজারের পতন দেখা যায় গত সপ্তাহে। সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল চলতি সপ্তাহের প্রথম দুই কার্যদিবসেও। আগের সপ্তাহে পুঁজিবাজার পতনের কারণ হিসেবে পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, বছরের শুরু থেকে দর বৃদ্ধি হওয়া শেয়ারগুলোর দর সংশোধন বাজারকে নেতিবাচক দিকে ধাবিত করেছে। এছাড়া কভিড সংক্রমণ বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কোম্পানির প্রান্তিক প্রতিবেদন প্রকাশের অপেক্ষায় থেকে নতুন বিনিয়োগে যেতে চাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। যেসব কোম্পানি প্রান্তিকে ভালো প্রবৃদ্ধির খবর দিতে পারবে, সেগুলোতে বিনিয়োগ বাড়বে বলে উল্লেখ করেছিলেন তারা। কিন্তু গত দুদিন এমন কিছু কোম্পানির দরপতন হয়েছে, যেগুলোর প্রান্তিক প্রতিবেদনে ভালো মুনাফার খবর পাওয়া গেছে।
ফলে পুঁজিবাজারের এ পতন স্বাভাবিক দর সংশোধন নাকি ‘জুজুর ভয়’, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিকটবর্তী ভবিষ্যতে পুঁজিবাজারে কভিড ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা।
এ বিষয়ে এক্সপো ট্রেডার্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী (সিইও) মো. শহিদুল হোসেন বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জুজুর ভয় কাজ করছে। সংক্রমণ বাড়বে কি না, লকডাউন হবে নাকি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান কোন দিকে যাবে ইত্যাদি আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। যার কারণে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলাফল বাজার নেতিবাচক।
লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের শেষ সপ্তাহ আর নতুন বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৭৫ দশমিক ৮১ পয়েন্ট সূচক বাড়ার পর হাত গুটিয়ে থাকা বিনিয়োগকারীরা ফিরতে থাকেন। তবে গত সপ্তাহে বাজার ওঠানামা করতে থাকায় আবার তৈরি হয় বিভ্রান্তি। কমে যায় লেনদেন। এক পর্যায়ে সূচক ৭ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসে রোববার। সেটি আরও কমে গিয়ে এখন দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৯২৬ দশমিক ২৯ পয়েন্টে। এছাড়া গতকাল অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএসইএস ৯ ও ডিএস৩০ সূচক ২৬ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে।
সূচকের সঙ্গে সোমবার লেনদেনেও টান লেগেছে। আগের দিনের তুলনায় লেনদেন কমেছে ১২০ কোটি টাকা। চলতি সপ্তাহের প্রথমদিন রোববার লেনদেন হয়েছিল এক হাজার ৩৩৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। গতকাল সেটি কমে হয়েছে এক হাজার ২১৫ কোটি ১ লাখ টাকা।
তবে পুঁজিবাজারের অনেকে স্টেকহোল্ডার এ পতনকে স্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে মিয়া আব্দুর রহমান সিকিউরিটিজের কর্মকর্তা শেখ ওহিদুজ্জামান স্বাধীন বলেন, বছরের শুরু থেকেই উত্থান দেখা গেছে পুঁজিবাজারে। ফলে এ সময়ে অনেক কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা গ্রহণ করছেন। লেনদেন কিন্তু তলানিতে নেমে যায়নি। প্রতিদিনই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে; যা এ পতনকে স্বাভাবিক দর সংশোধন হিসেবেই প্রমাণ করছে।
গতকাল লেনদেনে অংশ নেয়া সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদর কমতে দেখা গেছে। ৭২টি কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ার বিপরীতে কমেছে ২৬৪টির, দর পাল্টায়নি ৪৪টি কোম্পানির। অধিকসংখ্যক সিকিউরিটিজের দর কমায় সব খাতেই দরপতন হয়েছে। শুধু সেবা ও রিয়েল এস্টেট খাতে পঞ্চাশ শতাংশ করে কোম্পানির দর বৃদ্ধি ও পতন দেখা গেছে।
প্রধান খাতগুলোর মধ্যে কোনোটিতেই চাঙ্গাভাব দেখা যায়নি। প্রকৌশল খাতে ৩৪ শতাংশ, সাধারণ বিমা খাতের ২০ শতাংশ আর ব্যাংকের ১৮ শতাংশ কোম্পানির দর বেড়েছে।
দীর্ঘদিন পর লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে প্রকৌশল খাত। পরের অবস্থানগুলো ছিল বস্ত্র, ব্যাংক, ওষুধ ও রসায়ন এবং বিবিধ খাত। এই পাঁচ খাতেই আলাদাভাবে লেনদেন দশ শতাংশের বেশি হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পাঁচ খাতের অবদান দাঁড়ায় ৬০ শতাংশের বেশি।
গতকাল সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বেক্সিমকো। চলতি অর্থবছরের দুই প্রান্তিকে গত অর্থবছরের চেয়ে বেশি আয় করার তথ্য জানানোর পরও কোম্পানিটি দর হারাচ্ছে। অথচ গত বছর কোম্পানিটির শেয়ারদর ১০ গুণেরও বেশি বেড়েছে। এ কোম্পানিটির শেয়ারদর কমেছে ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ কারণে সূচক কমেছে ৮ দশমিক ২ পয়েন্ট। তারপরই আছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারদর ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমায় সূচক কমেছে ৭ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট।
বিপরীতে যেসব কোম্পানি সূচকে পয়েন্ট যোগ করতে পেরেছে, সেগুলোর অবদান খুব একটি বেশি ছিল না। সবচেয়ে বেশি ৪ দশমিক ৮০ পয়েন্ট যোগ করতে পেরেছে গ্রামীণফোন। কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইউনাইটেড পাওয়ারের দর ১ দশমিক ১৯ শতাংশ বাড়ায় সূচকে যোগ হয়েছে ৩ দশমিক ২৫ পয়েন্ট। বার্জার পেইন্টস, ফারইস্ট লাইফ, ন্যাশনাল পলিমার, এসিআই ফরমুলেশন, বাংলাদেশ বিল্ডিং সিস্টেমস, সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল ও আমান ফিড কিছু পয়েন্ট যোগ করেছে। সব মিলিয়ে এ ১০ কোম্পানি যোগ করতে পেরেছে ১৩ দশমিক ৮২ পয়েন্ট।