পুঁজিবাজারে তারল্য সংকটের মধ্যে একসঙ্গে তিনটি আইপিও আবেদন চলছে। এতে কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে যাবে।
আইপিও আবেদন গ্রহণের পর শেয়ার বরাদ্দ শেষে টাকা ফেরত দিতে ৪৫ কর্মদিবস লেগে যায়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দুই মাসের বেশি সময় টাকা আটকে থাকে।
গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পুঁজিবাজার যখন দর সংশোধনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সে সময় ফেব্রুয়ারির চতুর্থ সপ্তাহে বিএসইসি নতুন আইপিও অনুমোদন না দেয়ার কথা জানিয়েছিল। তবে এবার এই ধরনের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। সেই সঙ্গে আইপিও আবেদনে টাকার পরিমাণ কমানোর বিষয়েও কোনো ভাবনা নেই।
কোন কোম্পানির আবেদনে কত শেয়ার মিলেছে
লটের বদলে আইপিওতে সবার জন্য শেয়ার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত একেকজন সাধারণ বিনিয়োগকারী প্রতিটি আবেদনের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫৪টি শেয়ার পেয়েছেন বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ারের।
বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির একেকটি শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন ২৯ টাকা করে। এই হিসাবে প্রতিজনের লেগেছে ১ হাজার ৫৬৬ টাকা।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬০টি করে শেয়ার পেয়েছেন সাউথবাংলা ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা। এ জন্য ১০ হাজার টাকা আবেদন করলেও বিনিয়োগকারীর সেই আবেদন থেকে কেটে নেয়া হয়েছে ৬০০ টাকা।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪০টি করে শেয়ার পাওয়া গেছে একটি পেস্ট্রিসাইডসের। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের এই শেয়ারের বিপরীতে কেটে রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা।
অন্যদিকে সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার পাওয়া গেছে ১৯টি করে, বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে কেটে নেয়া হয়েছে ১৯০ টাকা আর একেকজন সোনালী লাইফের শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছেন ১৭টি করে, একেকজনের কাছ থেকে কাটা হয়েছে ১৭০ টাকা।
গত ১ এপ্রিল থেকে আইপিওতে সবার জন্য শেয়ার বরাদ্দের পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে স্থিরমূল্যে আইপিওতে আসা বিনিয়োগকারীরা ৫০০টি শেয়ার বরাদ্দের জন্য আবেদন করতেন ৫ হাজার টাকায়। আর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে যেসব কোম্পানি শেয়ার ইস্যু করেছে, সেগুলোর আইপিওতে টাকার পরিমাণ ভিন্ন হতো।
সোনালী লাইফকে দিয়ে যখন আইপিওতে প্রথম সবার জন্য শেয়ারের ব্যবস্থা চালু হয়, সে সময় থেকে ন্যূনতম ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ দেয়া হয় একেকজন বিনিয়োগকারীকে। পরে কেবল ১০ হাজার টাকার শেয়ারের জন্য আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়।
তবে ১৬০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৬০ টাকার শেয়ার যখন বরাদ্দ পাওয়া গেছে, সেখানে কেন ১০ হাজার টাকার আইপিও আবেদন করতে হবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
একসঙ্গে তিন আইপিওতে আটকে যাচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকা
মাস তিনেক আগে পুঁজিবাজার যখন চাঙ্গা ছিল, সে সময় নিয়মিত ২ হাজার থেকে পৌনে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। সে সময় আইপিও আবেদনের এই বিষয়গুলো সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। তবে এখন টেনেটুনে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, তারল্য সংকটের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে, সে সময় ‘অকারণে’ বেশি টাকায় আইপিও আবেদন কেন করতে হবে, সে প্রশ্ন তুলছেন বিনিয়োগকারীরা।
চলতি ডিসেম্বরে তিনটি আইপিওর জন্য টাকা জমা দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এর মধ্যে একটি ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের আবেদন শেষ হয়েছে।
কোম্পানিটি ১ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হজার ৯০৪টি শেয়ার ছেড়ে ১৯ কোটি ৩৬ লাখ ৯ হাজার ৪০ টাকা তুলবে।
যে দুটির আবেদন এখনও চলছে, তার মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংক ৪২ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার ছেড়ে ৪২৮ কোটি টাকা, বিডি থাই ফুডস দেড় কোটি শেয়ার ছেড়ে ১৫ কোটি টাকা তুলবে।
যদি ১৫ গুণও আবেদন জমা পড়ে, তার পরও তিনটি কোম্পানির জন্য আবেদন জমা পড়বে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক দেবব্রত কুমার সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইপিও আবেদন করার জন্য ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ থাকতে হবে এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে এখন যেহেতু আইপিও আবেদন করলেই শেয়ার পাওয়া যায়, সে জন্য যতগুলো শেয়ার পাওয়া যায় তার সমপরিমাণ টাকা জমা দেয়ার বিধান থাকা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি আবেদনে ১০ হাজার টাকা জমা দেয়া যৌক্তিকতা যাচাই করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা বাধ্যতামূলক রেখে আইপিও আকার অনুযায়ী জমার পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে।’
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের সংগঠন পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘আইপিও আবেদনে যে পরিমাণ টাকা জমা দিতে হয়, সে তুলনায় খুবই সামান্য টাকা শেয়ার পাওয়া যায়। তাই পুঁজিবাজারের স্বার্থেই আইপিওতে ন্যূনতম জমার পরিমাণ কমিয়ে আনা উচিত।’
বাজারে তারল্য সংকটের কারণে আপাতত আইপিও অনুমোদন না দেয়ার দাবিও জানিয়েছেন এই বিনিয়োগকারী।
কী বলছে বিএসইসি
যেখানে শেয়ার পাওয়া যায় নগণ্য সংখ্যায়, সেখানে আইপিও আবেদনের জন্য ১০ হাজার টাকা জমা দেয়ার প্রশ্নে বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ’১০ হাজার টাকার বিপরীতে যে পরিমাণ শেয়ার পাওয়া যায়, সে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগকারীদের যে লাভ হয়, তা ব্যাংকের রিটার্নের চেয়ে অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, ‘আবেদন ১০ হাজার টাকার কম বা ৫ হাজার টাকা করা হলে আবারও আইপিও সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠবে। আইপিও মার্কেটের শৃঙ্খলা আনার জন্যই এই টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।’
তারল্য সংকটে লেনদেন যখন তলানিতে নেমেছে, সে সময় কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকে থাকার বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘টাকা আটকে থাকার বিষয়টি সাময়িক। আবেদন করার পর টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে।’