ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিতে তিনটি বিশেষ খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথমটি হলো ব্যাংকিং খাত, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেটিকে নন-ব্যাংক ফিন্যানশিয়াল ইনস্টিটিউশন (এনবিএফআই) বা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়। তৃতীয়টি হচ্ছে পুঁজিবাজার। এই তিনটির মধ্যেই আন্ত সম্পর্ক রয়েছে এবং অর্থনীতিতে এরা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কারণ তিনটি খাতই শিল্পে অর্থায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ফিন্যানশিয়াল ইন্টারমিডিয়ারি বা আর্থিক মধ্যস্থতাকারী বলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলো ধারাবাহিকভাবে ভালো ভূমিকা রেখে আসছে। প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মার্কেট শেয়ারের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও এখন বেসরকারি ব্যাংক এগিয়ে। তবে আমাদের ব্যাংক খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত মাত্রায় ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে কভিড-উত্তর সময়ে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার সময়টিতে এটি আরো স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। তদারকি ও নজরদারির অভাব ব্যাংকিং খাতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা। এ ছাড়া দিন দিন ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ বিশেষ ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণগুলো কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে, যা করোনাকালীন প্যাকেজ বাস্তবায়নে স্পষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব। ফলে ব্যাংক পরিচালনায় যথেষ্ট স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলার অভাব দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির পেছনে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব কারণ যেমন আছে, তেমনি বাইরের কারণও আছে। এখানে কিছুটা আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয় আছে। যেমন—রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেখে অর্থ মন্ত্রণালয়, যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কম। এরপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পরিচালকদের হস্তক্ষেপ, ব্যবসায়ীদের প্রভাব, ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার অভাব রয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ আমরা প্রায় সময়ই দেখতে পাই না। এটিও বড় সমস্যা।
ব্যাংকিং খাতে আমাদের যে আইন ও নিয়ম-কানুনগুলো আছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন, ব্যাংক কম্পানি আইন অথবা জয়েন্ট স্টক কম্পানি আইন—এগুলো যথেষ্ট আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এসব আইন পরিপালন করা হয় না এবং না হওয়ায়ই উল্লিখিত সমস্যাগুলো দিন দিন বড় হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ৬০টির মতো ব্যাংক। আমার মতে, এই সংখ্যা অনেক বেশি।
অন্যদিকে ১৯৯৩ সালের আইনে পরিচালিত দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে তিনটি সরকারি। বাকিগুলোর মধ্যে ১৯টি স্থানীয় এবং ১২টি যৌথভাবে পরিচালিত। আমার মতে. দেশে এনবিআইএফের সংখ্যাও অনেক বেশি। বাংলাদেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড সীমিত। এরা মেয়াদি ঋণ নেয় শুধু এবং সীমিত কয়েকটি ক্ষেত্রে অর্থায়ন করে। তবে তারা ডিপোজিট নিতে পারে না। তারা এফডিআর নিতে পারে, তা-ও ন্যূনতম ছয় মাসের জন্য। এনবিএফআই ব্যাংক থেকে বা মানি মার্কেট থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। দেশে এনবিআইএফের একটা সমস্যা হলো এদের তারল্য সংকট থাকে প্রায়ই। ফলে যথাযথভাবে তারা ঋণ দিতে পারে না।
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ এক্সপোজার আছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এনবিএফআইগুলো তাদের মবিলাইজ করা অর্থ থেকে ঋণ দিয়ে থাকে, যা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন—সম্প্রতি আমরা দেখলাম, এক ব্যক্তি বিভিন্ন এনবিআইএফের চেয়ারম্যান ও এমডি হয়ে অর্থ তছরুপ করেন। এটি একটি সমস্যা। এ খাতের আরেকটি সমস্যা হলো কিছু এনবিএফআইয়ের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই এবং তাদের কার্যপরিধিও একেবারে কম। তারা যথাযথভাবে ভালো লোক নিয়োগ করে না, শুধু অফিস মেইনটেন করে। তার মানে তাদের কার্যক্রমও তেমন নেই, দক্ষতাও নেই। এ ধরনের অনেক লিজিং প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের থাকা না থাকা সমান। এ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব বড় একটি সমস্যা। দুর্নীতি, বোর্ডের সদস্যদের অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ এখানে প্রায়ই শোনা যায়। সবচেয়ে বড় হলো, এখানে ব্যাংকের তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি এবং সুপারভিশন অনেক কম। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যাংকগুলোর দিকেই বেশি সময় দিতে হয় এবং ব্যাংকের সংখ্যাও অনেক বেশি। দেশে এনবিএফআইয়ের আয়ের প্রধান উৎসই হলো আমানতের টাকা থেকে প্রদেয় ঋণ থেকে। প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ ঋণই আমানতের ওপর নির্ভরশীল। তবে সার্বিকভাবে এদের খেলাপি ঋণ কম, ৪-৫ শতাংশ, যেখানে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭-৮ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এই হার অনেক বেশি। অথচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের আন্তর্জাতিক মান হলো ৩ শতাংশ।
বাংলাদেশে কয়েকটি এনবিএফআই ভালো কাজ করছে; কিন্তু এদের শাখা কম। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ২০০ বা ২৫০টির মতো শাখা আছে বটে, কিন্তু নানা সমস্যায় জর্জরিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমিত পুঁজি নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু বাইরের দেশে এনবিএফআইগুলোকে অনেক ভালো করতে দেখা যায়। তারা গতানুগতিকতার বাইরে নতুন নতুন প্রডাক্ট ফিন্যান্স করে, মর্টগেজ, হেজিং করে, কিছু বন্ডও ইস্যু করে। আমাদের দেশে ইনোভেটিভ প্রডাক্ট নেই। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা বেশি, এনবিএফআইয়ের কম।
অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের ভূমিকা অনেক। অন্যান্য দেশে বৃহৎ শিল্পে এবং দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির উৎস হিসেবে পুঁজিবাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ আমাদের দেশে শিল্পপুঁজিতে ব্যাংকিং অর্থায়নের একচ্ছত্র প্রাধান্য। এটি আমাদের দেশের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। আমাদের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ব্যাংক মুখাপেক্ষী। অথচ ব্যাংকের সহজাত কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ আমানতের টাকা দিয়ে ব্যাংক চলে এবং সেটির এক্সপোজারও নিয়ন্ত্রিত। পুঁজিবাজারে একটি ইন্ডাস্ট্রি যখন আইপিও ইস্যু করে অথবা তার শেয়ারগুলো সেকেন্ডারি মার্কেটে ছাড়ে, তখন তার লাভ হলে বিনিয়োগকারীদেরও লাভ হয় আর ক্ষতি হলে তাদেরও ক্ষতি হয়। এটিকে বলা হয় রিস্ক শেয়ারিং। দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজারে আর্থিক ব্যবস্থাপনা অপেক্ষাকৃত উন্নত হয়। কারণ তাদের অডিট রিপোর্টের বিষয় রয়েছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের প্রশ্নের মুখেও থাকতে হয়। অথচ বাংলাদেশে আমরা এখনো শিল্পে অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারের দিকে যাইনি সেভাবে।
তবে বাংলাদেশে পুঁজিবাজারেও নানা সমস্যা রয়েছে। পুঁজিবাজারের দুটি দিক—শেয়ার মার্কেট ও বন্ড মার্কেট। বন্ড মার্কেট বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশে তেমন কিছু নেই। এখানে প্রায় শতভাগ বন্ড সরকারি। আবার শেয়ার মার্কেট, যেটিকে ইকুইটি মার্কেট বলে, সেটি বেশ উজ্জীবিত হলেও সমস্যার শেষ নেই। যেমন—ভালো আইপিও আসে না আবার জেড ক্যাটাগরির শেয়ারও ব্যাপক লেনদেন হচ্ছে, লোকজন ক্রয় করছে। এখানে ইনসাইডার ট্রেডিংও হয়। ব্রোকার আছে, স্টক এক্সচেঞ্জ, মার্চেন্ট ব্যাংকাররা কেউ কেউ ভেতরের তথ্যগুলো জানেন এবং সুযোগ নিয়ে ইনসাইডার ট্রেডিং করেন, দাম বাড়ান বা কমান। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। ইদানীং পুঁজিবাজারে সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু এর সুফল খুব বেশি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের পুঁজিবাজারে আস্থার অভাব বড় সমস্যা। অনেকেই এটিকে ফাটকা বাজারের মতো মনে করে এবং লাভ করেই বেরিয়ে যেতে চায়। আরেকটি সমস্যা হলো আইপিওতে ভালো প্রতিষ্ঠান না আসা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ছাড়া কোনো শেয়ারবাজার উন্নতি করে না। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করছে, কিন্তু তারা শেয়ার মার্কেটে আসতে চায় না। কারণ এখানে জবাবদিহির দরকার হয় এবং অনেক প্রতিষ্ঠানে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পছন্দ করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বলে দেওয়া যেত যে ইকুইটি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সীমার বেশি ঋণ আপনি পাবেন না, বাকিটুকুর জন্য আপনাকে শেয়ার মার্কেটে যেতে হবে। তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারত। আমি গভর্নর থাকার সময় চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সফল হইনি। কারণ তাদের অনেকেই চায়নি।
এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হলে এই তিন খাতের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি তিনটিকে একই সূত্রে গাঁথতে হবে। ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মধ্যে একটা বিতর্ক চলছে। এর মানে সমন্বয়ের অভাবটা স্পষ্ট। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির বসে এর সমাধান করা উচিত। আমার সময় অন্তত মাসে একবার করে গভর্নর ও কমিশন চেয়ারম্যানের বৈঠক হতো। আগে থেকেই ইস্যুগুলোও নির্ধারণ করা থাকত। মোদ্দা কথা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক্সপোজারের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক শৃঙ্খলার এখতিয়ার থাকতে হবে। তাই কমিশন যখন কোনো কম্পানিকে লভ্যাংশের অর্থ দিয়ে দিতে বলবে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক এখতিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ও থাকতে হবে। না হলে পুঁজিবাজারের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে না।
পরিশেষে আমি বলব, তিনটি খাতের মধ্যে যদি সমন্বয় না হয়, তিন খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি যথাযথ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে কিন্তু প্রতিটি খাতের সমস্যা অন্য খাতগুলোর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে। তাই তিন খাতের সমন্বয় জরুরি, না হলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটবে। কালেরকন্ঠ থেকে সংগ্রহীত।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।