আইনি জটিলতার কারণে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স গত দুই ধরে বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে পারছে না। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে অ্যাকচুরিয়াল বেসিস অনুমোদন না পাওয়ার কারণে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ থমকে গেছে এবং ডিভিডেন্ড ঘোষণাও বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে, কোম্পানিটির নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভেঙে দেয়া হয় পর্ষদ, নিয়োগ দেয়া হয় প্রশাসক। আবার চার মাসের মাথায় প্রশাসক পরিবর্তনও করা হয়। এসব অনিশ্চয়তা ও বিতর্কের মধ্যে গত ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ বা ২০০ শতাংশ।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ৪ এপ্রিল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ডেল্টা লাইফের শেয়ারদর ছিল ৬২ টাকা ৪০ পয়সা। এদিন ডিএসইতে কোম্পানিটির ১১ হাজার ৪৮২টি শেয়ার লেনদেন হয়। এর পর থেকেই ডেল্টা লাইফের শেয়ারদর বাড়তে শুরু করে। এ বছরের ২৮ জুন কোম্পানিটির সবচেয়ে বেশি ১ কোটি ৫ লাখ শেয়ার লেনদেন হয়। সর্বশেষ সোমবার (০৪ অক্টোবর) কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৮৬ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়ায়। এদিন ডিএসইতে কোম্পানিটির ১৬ লাখের বেশি শেয়ার লেনদেন হয়।
কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়ে ডিএসইর পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়। এর জবাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধি ও শেয়ারের লেনদেন বেড়ে যাওয়ার পেছনে কোনো ধরনের মূল্যসংবেদনশীল তথ্য নেই।
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক পরিচালক জিয়াদ রহমান এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণমাধ্যমকে বলেন, আইডিআরএ কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই আমাদের অ্যাকচুরিয়াল বেসিস অনুমোদন আটকে রেখেছে। এতে আমরা আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারছি না। এজন্য এজিএমও আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কোম্পানির পলিসিহোল্ডার ও শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিটির শেয়ার দর কেন বাড়ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।
এদিকে, আইডিআরএর কাছ থেকে ছাড়পত্র না পাওয়ার কারণে ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০১৯ হিসাব বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করতে পারেনি ডেল্টা লাইফ। এতে ২০২০ হিসাব বছরের অনিরীক্ষিত ও নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের বিষয়টিও ঝুলে গেছে। এমনকি চলতি ২০২১ হিসাব বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করতে পারেনি কোম্পানিটি। ডেল্টা লাইফ সর্বশেষ ২০১৯ হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। আর্থিক প্রতিবেদনের পাশাপাশি কোম্পানিটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজনের বিষয়টিও আটকে রয়েছে। এতে কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা দুই বছর ধরে কোনো ধরনের ডিভিডেন্ডও পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় ডেল্টা লাইফের শেয়ারদরে উল্লম্ফনের বিষয়টি রহস্যজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেয়ারবাজারের এক আলোচিত বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির শেয়ারে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন। তারা রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছ থেকেও কোম্পানিটির বড় অংকের শেয়ার কিনেছেন। এসব কারণে আর্থিক পারফরম্যান্স দৃশ্যমান না হলেও ডেল্টা লাইফের শেয়ারদর বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
এদিকে কারণ ছাড়াই ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের নজরদারির আওতায় রয়েছে। কোম্পানিটির শেয়ার কারা কিনছেন সে তথ্য আমাদের কাছে আছে। এরই মধ্যে আইসিবি কর্তৃক ডেল্টা লাইফের শেয়ার বিক্রির বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। এক্ষেত্রে সিকিউরিটিজ আইনের কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পর্ষদকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এ সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হয় কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ। পাশাপাশি কোম্পানির পক্ষ থেকে আইডিআরএর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবির অভিযোগ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখছে। অন্যদিকে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকেও কোম্পানিটির পর্ষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
এমন অবস্থার মধ্যে কোম্পানিটির ওপর আইডিআরএর পক্ষ থেকে বিশেষ ও অনুসন্ধানমূলক নিরীক্ষা করানো হয়েছে, যাতে বেশকিছু অনিয়মও উঠে এসেছে। বিএসইসিও কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকেও ডেল্টা লাইফের বিরুদ্ধে বড় অংকের রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সমস্যায় জর্জরিত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। তারপরও কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়ছে হু হু করে।
বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে যারা খেলছেন, তাদের হাত খুব লম্বা। তারা কাউকেই তোয়াক্বা করে না। যতই তদন্ত কমিটি হোক বা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হোক, এ বিষয়ে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা তাদের খেয়াল-খুশী মতো শেয়ারটির দর নামাচ্ছে, উঠাচ্ছে।