দেশের ১৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক খাতের মতো খেলাপি ঋণ কম দেখাতে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যালেন্সশিট (হিসাবের খাতা) কাগজে-কলমে স্বচ্ছ দেখালেও ভেতরের চিত্র উল্টো। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো যে ভালো অবস্থানে নেই, তা দেখে বোঝা যাবে না। অথচ কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ অবলোপন করেছে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। গত দুই বছরে (২০১৯ ও ২০২০) অবলোপনের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে১৩ এসেছে এসব তথ্য।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ দেশে বর্তমানে নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৩৪টি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকায়। এর সঙ্গে উল্লিখিত অবলোপন যোগ করলে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন-অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়েছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতের শৃঙ্খলা। ব্যাপক লুটপাটের কারণে ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে পারছে না এসব প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক যেমন বড় বাজার ধরে রেখেছে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তেমন নয়; এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার খুবই ছোট। সেই ছোট বাজারে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের শত শত কোটি টাকা অবলোপন করা হয়, তবে সেটা নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঋণ অবলোপনের শীর্ষে রয়েছে আভিভা ফাইন্যান্স (সাবেক রিলায়েন্স)। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে অবলোপন করেছে ২৯১ কোটি টাকা। তখন খেলাপি ছিল ১৪.০৫%। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চে সে খেলাপি আরও বেড়ে ১৬.১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বিপুল অঙ্কের অবলোপন না করলে খেলাপি ঋণের হার আরও অনেক বেশি থাকত।
২০২০ সালে ২৬৩ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ অবলোপন করেছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)। এরফলে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি নেমে আসে ১.৫৩ শতাংশে। এখানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যালেন্সশিট সাময়িক ভালো দেখালেও প্রকৃত খেলাপি অনেক বেশি।
খেলাপি ঋণ অবলোপনে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ১৩ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে লংকা বাংলা ফাইন্যন্স ২০১৯ ও ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ২৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এরফলে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণ নেমে আসে ৪.৪০ শতাংশে। যদিও বর্তমানে তা আবার ৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
একই সময়ে আইডিএলসি ফাইন্যান্স ১৪৮ কোটি, ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ১১০ কোটি এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ১০৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে।
এছাড়া ১০০ কোটি টাকার নিচে এবং ১০ কোটি টাকার উপরে ঋণ অবলোপন করা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে শেয়ারবাজারের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ৯৭ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ৮১ কোটি, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ৭৬ কোটি, পিপলস লিজিং ৭৪ কোটি, মাইডাস ফাইন্যান্স ৪৯ কোটি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ৩৮ কোটি, আইপিডিসি ফাইন্যান্স ৩৪ কোটি, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ৩২ কোটি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স ২৭ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ২৪ কোটি টাকা এবং বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
সার্বিকভাবে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম বলেন, যেসব বড় অংকের খেলাপি হয়েছে, এর বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। আর এখানে তাদের ধরার জন্য পরিবেশও গড়ে উঠেনি। বিশেষ করে আইনি সহায়তা পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ২২ বছর লড়ে এখনও একটা ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়নি। সে কারণে অবলোপনের পথে যেতে হয়েছে। সুতরাং ঋণ দেয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে দিলে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় না।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে ঋণ অবলোপন নীতিমালা শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে তিন বছরের পুরোনো খেলাপি ঋণ অবলোপন করার সুযোগ দেয়া হয়। যা আগে ছিল ৫ বছর। এছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করতে পারছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে চালু হয় ‘লোন রাইট অফ’ বা ঋণ অবলোপন পদ্ধতি। শুরুতে যেসব খেলাপি ঋণ পাঁচ বছরেও আদায় করা যায়নি, সেগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে অবলোপন করা যেতো। মূল খাতা থেকে বাদ দিয়ে অন্য একটি খাতায় হিসাব রাখার নামই ঋণ অবলোপন। এর আগে সুদাসলে ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে একটি মামলা দায়ের এবং শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রভিশনের টাকায় অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যায় না। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর