মহামারি করোনার থাবার মধ্যেও দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি । রয়েছে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম জনশক্তি। এক-তৃতীয়াংশ মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য ১৭ কোটি মানুষের বাজার। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের কার্যকর নীতি সহায়তা জরুরি।
শিল্পায়নের পুঁজির জন্য মুদ্রা ও পুঁজিবাজারকে কাজে লাগাতে হবে। আসন্ন বাজেটেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পরিচালক মো. ছায়েদুর রহমান এসব কথা বলেন।
বিএমবিএ সভাপতির মতে, উন্নত সব দেশই পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে এখনো পুঁজিবাজারকে আর্কষণীয় করা যায়নি। এখনো শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা যায়নি। অর্থনীতির স্বার্থেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি। এছাড়া মুদ্রা ও বাজার নিয়েও খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন : সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ছায়েদুর রহমান : করোনার মধ্যেও আমাদের বেশকিছু সূচক অত্যন্ত ভালো অবস্থানে। রপ্তানি বাড়ছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি রেমিট্যান্সে (প্রবাসী আয়) রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এ পরিমাণ রিজার্ভ দিয়ে প্রায় এক বছরের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। এসব অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। তবে করোনায় কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশকিছু মানুষের কাজ চলে গেছে। উল্লেখযোগ্য মানুষের আয় কমেছে। নতুন বিনিয়োগ সেভাবে নেই। ফলে সবকিছু আগের অবস্থায় নিয়ে আসা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ। তবে আমার ধারণা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুতই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
প্রশ্ন : করোনার অভিঘাতে দেশের অর্থনীতির জন্য কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে?
ছায়েদুর রহমান : শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো বিশ্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে করোনা মহামারি। পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। পাশের দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ফলে সেদেশের অর্থনীতি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কোনো দেশই প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে যে আশঙ্কা করা হয়েছিল সেই তুলনায়, এ পর্যন্ত আমাদের অবস্থা ভালো।
এরপরও করোনার বড় ধাক্কা লেগেছে আমাদের অর্থনীতিতে। অর্থনীতির সব হিসাব পালটে দিয়েছে করোনা। তাই আমাদের নতুন করে হিসাব করতে হচ্ছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করবে এ ভাইরাস কতদিন থাকে এর ওপর। প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা আমরা মোটামুটি কাটিয়ে উঠেছিলাম। এরপর দ্বিতীয় ঢেউ এলো, যা আগের হিসাব পালটে দিয়েছে। তবে ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন এসেছে।
আর ভ্যাকসিন আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে। দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে অর্থনৈতিকভাবেও আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব। আরেকটি বিষয় লক্ষ করবেন, যে কোনো চ্যালেঞ্জের পাশেই একটি সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে পোশাক খাতে আমরা সম্ভাবনা দেখছি। কারণ বাংলাদেশ থেকে যে ধরনের পোশাক বিদেশে রপ্তানি হয়, তা বিলাসী পণ্য নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাক। অর্থাৎ কম দামি কাপড়। এক্ষেত্রে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি খারাপ হলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের নাগরিকরা কম দামি পোশাক পরবে। এতে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রশ্ন : করোনায় দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা কেমন?
ছায়েদুর রহমান : আর্থিক খাতের দুটি অংশ-মুদ্রাবাজার ও পুঁজিবাজার। বর্তমানে মুদ্রাবাজারের অবস্থা মোটামুটি ভালো। ঋণ দেওয়ার জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যাংকিং খাতে রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উত্তরণ হলে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণে যাবে। কিন্তু পুঁজিবাজারের অবস্থা সেভাবে ভালো নয়। এখানে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এখানে ভালো কোম্পানি কম। এছাড়া বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা বিরাজমান। এর কারণ হলো বাজারকে সেভাবে আমরা ব্র্যান্ডিং করতে পারিনি। তবে করোনার মধ্যেও বর্তমানে মাত্র আড়াই ঘণ্টায় যেভাবে লেনদেন হচ্ছে, তাতে আমরা আশাবাদী। মনে হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিভিন্ন পদক্ষেপে বাজার শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন : এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ আশা করছেন?
ছায়েদুর রহমান : পুঁজিবাজার হলো একটি মাধ্যম। এখানেই উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সমন্বয় ঘটে। একটু সহজ করে বললে, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য একজন উদ্যোক্তার টাকা দরকার। অপরদিকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় রয়েছে, যা বিনিয়োগের জায়গা নেই। পুঁজিবাজার এ দুই শ্রেণির মানুষের সমন্বয় করিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে একদিকে উদ্যোক্তা তার প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান পেল, অপরদিকে সঞ্চয়কারীও পুঁজি থেকে মুনাফা অর্জনের সুযোগ পেল। তবে পুঁজিবাজারে অনেক জবাবদিহিতার বিষয় রয়েছে। আমরা সরকারকে বলেছি, ভালো কোম্পানি যাতে বাজারে আসে, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আর এটি করতে পারলেই বাজারে নতুন পুঁজি আসবে। এতে বাজারে কারসাজির সুযোগ কমবে।
প্রশ্ন : সুনির্দিষ্টভাবে আপনারা বাজেটে কী চেয়েছেন?
ছায়েদুর রহমান : বাজারে শেয়ার সরবরাহ বাড়াতে আমরা তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ৫ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছি। এর যুক্তি হলো, বর্তমানে শেয়ারবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানির কর হলো সাড়ে ৩২ শতাংশ। এক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ও বহির্ভূত কোম্পানির করের পার্থক্য মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। এ হারে কর সুবিধা নিয়ে কেউ বাজারে আসতে চাইবে না। সরকার হয়তো মনে করতে পারে, কর আরও কমালে বছর শেষে দেশে রাজস্বের পরিমাণ কমবে।
কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক নয়। উলটা শেয়ারবাজারে নতুন কোম্পানি এলে সরকারের আয় আরও বাড়বে। কারণ বর্তমানে যেসব কোম্পানি বাজারের বাইরে রয়েছে, সেগুলো ওইভাবে নজরদারি করা হয় না। কিন্তু কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে এলে অনেক ধরনের নজরদারি আওতায় চলে আসে। এতে কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে যায়। এছাড়া শেয়ারবাজারে কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হলে সরকার অনেক ধরনের কর পায়। এখানে সবকিছু প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়। ফলে লেনদেনের সঙ্গে সঙ্গে কর আলাদা করে কেটে রাখা হয়। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
প্রশ্ন : কর কমালেই শেয়ারবাজার শক্তিশালী হবে?
ছায়েদুর রহমান : বাজারকে শক্তিশালী করার জন্য এটি একমাত্র উপাদান নয়। তবে এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। উদাহরণস্বরূপ, এ বাজারে অন্যতম সমস্যা দ্বৈতকর। প্রথমত, একটি কোম্পানি করপোরেট কর দেওয়ার পর লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরপর একজন বিনিয়োগকারীকে কোম্পানি থেকে যখন লভ্যাংশ দেওয়া হয়, সেসময় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আগাম কর কেটে রাখা হয়। কিন্তু ওই বিনিয়োগকারী যখন ব্যক্তিগত রিটার্ন দাখিল করেন, তখন শেয়ারবাজার থেকে পাওয়া লভ্যাংশের ওপরও কর দিতে হয়। অর্থাৎ একই আয়ের ওপর ২ থেকে ৩ বার কর দিতে হয়। কোনো বিবেচনায় এটি যৌক্তিক নয়।
দীর্ঘদিন থেকে আমরা এ দ্বৈতকর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছি। আর এ দ্বৈতকর প্রত্যাহার হলে শেয়ারবাজারে নতুন বিনিয়োগ বাড়বে। এছাড়া গত বছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। আমরা দাবি করেছি, এ বছর এটি অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এ সুযোগ দেওয়ার ফলে বাজারে তারল্যপ্রবাহ বেড়েছে। এছাড়া এ খাতে সরকার ভালো অঙ্কের একটি রাজস্ব পেয়েছে। অপ্রদর্শিত আয়কে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে সুযোগটি থাকা উচিত। এছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকের বর্তমান করপোরেট কর সাড়ে ৩৭ শতাংশ। এটি আমরা ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছি।
পাশাপাশি লেনদেনের করও কমানোর দাবি করেছি। বর্তমানে বাজারে শেয়ার লেনদেনের জন্য দশমিক ০৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এ হার আগে ছিল দশমিক ০১৫ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমানে ১ লাখ টাকা লেনদেন করলে একজন বিনিয়োগকারীকে ৫০ টাকা কর দিতে হয়, আগে যা ছিল ১৫ টাকা। আমরা লেনদেনের করকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করছে, বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ছায়েদুর রহমান : সারা বিশ্বেই শেয়ারবাজারে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ থাকে। অস্বীকার করা যাবে না, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে কিছু কোম্পানির শেয়ার অযৌক্তিক মূল্যে লেনদেন হয়। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো শেয়ারের সংখ্যা কম এবং বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণের অভাব।
আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে বলে আসছি। কারণ শক্তিশালী কোম্পানি বিনিয়োগ করলে দীর্ঘমেয়াদে অবশ্যই তারা লাভবান হবে। আর বাজারে ভালো শেয়ারের সংখ্যা বাড়লে কারসাজি কমে যাবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। এতে স্বচ্ছতা বাড়বে। যুগান্তর।