দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ন্যাশনাল ফিড মিলের কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে একটানা দর বাড়ছে। গত ১৪ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর প্রায় দ্বিগুন বেড়েছে। ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে নামে মাত্র ৩দিন দর কমেছে। বর্তমানে কোম্পানিটির দর একটানা বাড়লেও শোকজ করা হচ্ছেনা। এই অস্বাভাবিক হারে দর বাড়ার পেছনে কারসাজি রয়েছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সূত্র মতে, গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার দর এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দর ছিল ৮ টাকা ৭০ পয়সা। গত ১১ এপ্রিল ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন দর ছিল ১৪ টাকা ৬০ পয়সা। ২৯ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ২৬ টাকা ১০ পয়সা। যা গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত সপ্তাহে ডিএসইতে কোম্পানিটি সাপ্তাহিক গেইনার তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। সপ্তাহজুড়ে শেয়ারটির দর ৩৯.৫৭ শতাংশ বেড়েছে।
আলোচ্য সপ্তাহে শেয়ারটি সর্বমোট ১২২ কোটি ৭৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা লেনদেন করে। যা গড়ে প্রতিদিন ২৪ কোটি ৫৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিটি ২০১৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এর অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন যথাক্রমে- ২০০ কোটি টাকা এবং ৯২ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। বর্তমানে কোম্পানির রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এ কোম্পানির ৯ কোটি ২৪ লাখ ৩৬ হাজার ৯৫৫টি শেয়ারের মধ্যে ৩০.৪০ শতাংশ উদ্যোক্তা পরিচালক, ১৪.৭৩ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ০.৮০ শতাংশ বিদেশি এবং ৫৪.০৭ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে।
চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই‘২০-সেপ্টেম্বর’২০) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ২৭ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ১৩ পয়সা। একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি ৬ সম্পদ (এনএভি) হয়েছে ১৩ টাকা ৩৬ পয়সা
দ্বিতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর,২০) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৩৩ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৯ পয়সা।
৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর,২০) কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৫৯ পয়সা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ২১ পয়সা।
একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি সমন্বিত সম্পদ (এনএভি) হয়েছে ১৩ টাকা ৩৫ পয়সা।
কোম্পানিটি ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদেরকে ২ শতাংশ ক্যাশ এবং ৮ স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছিল।
এদিকে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ৫ বছরের মধ্যে শেষ ৩ বছর ধরে ব্যবসায় ধুকছে ন্যাশনাল ফিড মিল। আর এই কোম্পানিটি থেকেই উদ্যোক্তা/পরিচালকদের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে অবৈধভাবে টাকা সড়ানো হয়েছে। এতে লাভবান হচ্ছে উদ্যোক্তা/পরিচালকেরা। আর প্রতারিত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
কোম্পানিটির ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষায় নিরীক্ষকের প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
ন্যাশনাল ফিড মিল ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ কোম্পানিটি শেয়ারবাজার থেকে ১৮ কোটি টাকা সংগ্রহের পরে ২ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ১ টাকার উপরে থাকে। এরপরে শুরু হয় পতন। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ০.৫৬ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ০.১৫ টাকা ও সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ০.১৭ টাকা ইপিএস হয়েছে। ব্যবসায় এমন দূর্বল কোম্পানিটি থেকে পরিচালকদের ব্যক্তিগত ৩ কোম্পানিতে প্রায় ৭ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে।
কোম্পানিটির ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর্থিক হিসাবের নোট-৭এ অ্যাডভান্স, ডিপোজিট ও প্রিপেমেন্টস হিসাবে ৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এরমধ্যে কোন স্বার্থ ছাড়াই উদ্যোক্তা/পরিচালকদের নিজেদের কোম্পানি ন্যাশনাল ইলেকট্রোড অ্যান্ড ইলেকট্রনিকসে ২২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কর্ণপুর অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। এরমধ্যে ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা বিনা স্বার্থে প্রদান করা হয়েছে এবং বিক্রিবাবদ ৬৮ লাখ ৯ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে।
এছাড়াও ন্যাশনাল হ্যাচারি লিমিটেডের কাছে ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এরমধ্যে ৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে বিনা স্বার্থে এবং ৬৯ লাখ টাকা বিক্রিবাবদ পাওনা রয়েছে।
উদ্যোক্তা/পরিচালকদের সম্পর্কিত এসব কোম্পানিতে বিনা স্বার্থে অর্থ প্রদান করা হলেও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক। এরফলে বিএসইসি নোটিফিকেশন নং বিএসইসি/সিএমআরআরসিডি/২০০৯-১৩২/২/এডমিন লঙ্ঘন করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ফিড মিলের ২০১৯ সালের ৩০ জুন বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে বাকিতে বিক্রির কারনে পাওনা টাকা ছিল ৭২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। যা ২০২০ সালের ৩০ জুন বেড়ে হয়েছে ৭৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এভাবে নিয়মিত গ্রাহকের কাছে পাওনা টাকার পরিমাণ বাড়লেও বছরভিত্তিক গ্রাহকদের কাছ থেকে সন্তোষজনক আদায় হচ্ছে না। আদায়ে ঝুকিঁ থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কোন পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।
এদিকে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে পাওনা টাকা আদায়ে প্রত্যাশিত ক্ষতির জন্য কোন সঞ্চিতিও (প্রভিশন) গঠন করেনি বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক। এর মাধ্যমে মুনাফা ও সম্পদ বেশি দেখাচ্ছে ন্যাশনাল ফিড কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ি, মুনাফার ৫ শতাংশ দিয়ে ওয়ার্কার্স প্রফিট অ্যান্ড পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএফ) গঠন করতে হয়। তবে ন্যাশনাল ফিডের ম্যানেজমেন্ট তাদের মতো করে এই ফান্ডের পরিমাণ নির্ধারন করেছে এবং সঞ্চিতি গঠন করেছে। তবে কোন অর্থ শ্রমিকদের প্রদান করেনি বলে জানিয়েছেন নিরীক্ষক।