‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ আজ এশিয়ার ৫ম অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পথে। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিশ্বজুড়ে আজ অনুকরণীয়।
করোনা মহামারি সত্ত্বেও বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ৫.২৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাস্তবমুখী ও পর্যাপ্ত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার বর্তমান অর্থবছরে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিসঞ্চার, কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রেখেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও বর্তমান অর্থবছরের বাকি সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলমান এই ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভবপর হবে।
করোনাকালে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য চলকগুলোর ইতিবাচক অবস্থা, বিশেষ করে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি, রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি, প্রবাস আয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতির নিম্নগতি নির্দেশ করে যে, দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকে এগিয়ে চলেছে।
বিশ্ব অর্থনীতির উপর করোনাভাইরাসের আঘাত সত্ত্বেও সরকারের কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে দেশের অর্থনীতির সুদৃঢ় অন্তর্নিহিত শক্তি ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক চালিকা শক্তিগুলোকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে দেশকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সচেষ্ট রয়েছে সরকার। সর্বোপরি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও গতিশীল নেতৃত্ব এবং সুচারু পরিচালন দক্ষতায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১, বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঠিক ও সময়োপযোগী বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি সুখী ও সমৃদ্ধ উন্নত দেশে পরিণত হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনার এক যুগ ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধেও তাঁর সুদক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছে। দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন শেষে সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ ২য় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১)-এর বাস্তবায়নও শুরু করেছে। সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া। বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট বাস্তবায়ন এবং ব-দ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০ বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেওয়া।
কোভিড-১৯ মহামারিজনিত বৈশ্বিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা কিছুটা শ্লথ হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমে ৫.২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২,০৬৪ মার্কিন ডলারে। ২০১৯ সালে দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার কমে যথাক্রমে ২০.৫ ও ১০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি দিক নির্দেশনায় সরকার সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সংবলিত ১ লক্ষ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা (জিডিপি’র ৪.৩৪ শতাংশ) ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার বাস্তবায়ন কাজ বর্তমানে পুরোদমে চলছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫০ বছরে মোট ৪৯টি বাজেট পেয়েছে দেশের জনগণ। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। আর চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৫ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন।
রাস্তাঘাট, বন্দর ও জ্বালানি সুবিধার মতো সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রশংসা করে তিনি পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, ১৬ কোটির বেশি মানুষের দেশটিতে এটা হতে যাচ্ছে সমৃদ্ধির এক নতুন যুগ।
বাংলাদেশে প্রায় ত্রিশ লাখ গার্মেন্টস কর্মীর পরিশ্রমে দেশটি এখন চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে।
একসময় এদেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। কিন্তু এখন এই অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।
নরওয়ের গবেষক ইরিক জি জনসেন গত চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ নিয়ে নিবিড়ভাবে পড়াশুনা করছেন। তিনি বলছেন, বর্তমানে ১০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন।
তার সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে ধানের ফলন অনেক বেড়েছে যা অবাক করার মতো। দেশটির ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪১ বছর সেখানে এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর।
গত এক দশকে বাংলাদেশের বার্ষিক অর্থনীতি ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২০ সাল থেকে মাথাপিছু জিডিপি চারগুণ বেড়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার।
মূলত প্রান্তিক পর্যায়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং উৎপাদন, রফতানি বৃদ্ধি -সবমিলিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশে।
শুরুতে কৃষি খাত এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখলেও ৮০’র দশক থেকে সেখানে মূল ভূমিকা রাখতে শুরু করে শিল্প খাত। আরো নির্দিষ্ট করে বললে তৈরি পোশাক খাত। রফতানি এবং কর্মসংস্থান দুটো ক্ষেত্রেই তৈরি পোশাক খাতের বড় ভূমিকা আছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন সাম্রাজ্যবাদী সহায়তা পুষ্টদাতা গোষ্ঠীকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে বিশ্বের বুকে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করা। যারা সেদিন কথায় কথায় তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তাচ্ছিল্য করেছে, তারাই আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বিশ্ব দরবারে উন্নত দেশ হিসেবে স্থান করে নেবে লাখো মানুষের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।