অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকমে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের বিনিয়োগ করা অর্থ এক মাসের মধ্যে ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
বিএসইসির চেয়ারম্যান একটি নিউজ পোর্টালকে বলেন, ‘এটা ঘটেছিল তিন চার বছর আগে। তখন আমরা ছিলাম না। আমরা যখন জানতে পারি তখন ব্যবস্থা নেই। আমরা ফান্ড ফেরত নিয়ে আসতেছি। এক মাসের মধ্যে বিডিনিউজ থেকে ফান্ড ফেরত যাবে।’
এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিয়াজ ইসলামের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জানিয়ে প্রতিকার চেয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এলআর ম্যানেজারস ইনভেস্টমেন্টস।
নিয়মবহির্ভূতভাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে গিয়ে রিয়াজ ইসলাম ও তৌফিক ইমরোজ খালিদী বিএসইসির এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে আটকে আছেন।
আর্থিক খাতে বড় ধরনের দুর্নীতির ওই ঘটনায় বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে। টাকার অঙ্কে তার আর্থিক দুর্নীতির পরিমাণ জানতে ৮০টি সংস্থার কাছে চিঠি দিয়েছে দুদক।
এরই মধ্যে তৌফিক ইমরোজের হাতে জনগণের অর্থ তুলে দেয়া রিয়াজ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলছে তার বিদেশি অংশীদাররা। বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় রিয়াজ ইসলামের নামে থাকা সব শেয়ার কিনে নেয়ার আগ্রহ দেখিয়ে এ বিষয়ে বিদেশি অংশীদাররা বিএসইসির অনুমতি চেয়েছে।
এলআর গ্লোবালের অংশীদার গ্যাভিন উইলসন গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিএসইসিকে পাঠানো এক চিঠিতে রিয়াজ ইসলামের প্রতারণা ও অনিয়মের নানা তথ্য তুলে ধরে প্রতিকার চান। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে এলআর গ্লোবাল কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং এর আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে বহু বছর ধরে তারা অবগত নন।
গ্যাভিন উইলসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এলআর গ্লোবালের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের অংশীদার নিউইয়র্কভিত্তিক এলআর ম্যানেজারস ইনভেস্টমেন্টস। বাকি ৫২ দশমিক ৩ শতাংশের অংশীদার রিয়াজ ইসলাম। তবে রিয়াজ তাদের সঙ্গে সব ধরনের তথ্য আদান-প্রদান ও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন।
গ্যাভি উইলসন লিখেছেন, ‘গত আট বছরে কোম্পানির অংশীদার এবং ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের মালিক হওয়া সত্ত্বেও ডিভিডেন্ড হিসেবে আমাদের একটি টাকাও দেওয়া হয়নি। যদিও তারা প্রতিবছর ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে।’
বিদেশি এই অংশীদার আরও বলেন, ‘এ ছাড়া আমরা বুঝতে পারছি যে, রিয়াজ ইসলাম তার বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে প্রতারণা করে কোম্পানির বেতন-ভাতা, বোনাস এবং বিভিন্ন খরচ নিয়মিত গ্রহণ করছেন।’
বিএসইসিকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, রিয়াজের একক নিয়ন্ত্রণ এবং কোম্পানি পরিচালনা সম্পর্কে অন্যান্য ফান্ড স্পন্সরদের একই রকম উদ্বেগ ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বাংলাদেশের মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে এবং এলআর গ্লোবালের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আগেই চলমান এই ধারার সংশোধন প্রয়োজন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
‘আমরা এই পরিস্থিতিতে আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি আলোচনার জন্য সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চেয়ে এবং এখনকার এই অবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে সব স্পন্সরের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি।’
সব অংশীদারের আস্থা ও সমর্থন ফিরে পেতে ওই চিঠিতে রিয়াজ ইসলামের শেয়ার কিনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে বিএসইসির অনুমতি চেয়েছেন এলআর গ্লোবালের বিদেশি এই অংশীদার।
তিনি এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ ও রিয়াজ ইসলামের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো অবহিত থাকার কথা জানিয়ে লিখেছেন, রিয়াজের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয় তাদের জানা আছে। কিন্তু বামকো যাতে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চান তারা।
এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের আওতায় রয়েছে ছয়টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড। এগুলো হলো ডিবিএইচ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, গ্রিন ডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এআইবিএল ফার্স্ট ইসলামিক মিউচুয়াল ফান্ড, এমবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ মিউচ্যুয়াল ফান্ড ওয়ান এবং এনসিসিবিএল ফান্ড ওয়ান।
এই ছয়টি তহবিলের পরিমাণ ৮৭০ কোটি টাকা এবং এগুলোর বাজারে নেট অ্যাসেট ভ্যালু এখন প্রায় ৯৮০ কোটি টাকা। ২০০০ সাল থেকে এল আর গ্লোবাল বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে আসছে। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এবং এর বিনিয়োগকারীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।
বিদেশি অংশীদার থাকায় বাংলাদেশের শেয়ার বাজার এবং বিনিয়োগ সুবিধার জন্য আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশ। তবে রিয়াজ ইসলাম ধীরে ধীরে এটি কুক্ষিগত করেন বলে অভিযোগ আছে, যা সবগুলো মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
এর আগে ২০১৫ সালে বিনিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে বিএসইসি এলআর গ্লোবাল ফান্ডকে শাস্তি হিসেবে এক বছরের জন্য সব ধরনের ফান্ড বা স্কিম চালু থেকে বিরত রাখে। ওই সময় ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এলআর গ্লোবাল কর্তৃপক্ষকে।
সেই এলআর গ্লোবাল অ-তালিকাভুক্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজের শেয়ার ৫০ কোটি টাকায় কেনার ঘোষণা দিলে অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ্য আলোচনায় আসে। দুদক, বিএসইসি ও আইনজ্ঞরা বলছেন, এই শেয়ার কেনাবেচায় বেশ কয়েকটি অনিয়ম হয়েছে।
গত বছরের ৩০ জুলাই তৌফিক ইমরোজ খালিদীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এর আগে ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর জ্ঞাত আয়ের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে খালিদীর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ১১ নভেম্বর দুদকে হাজির হয়ে খালিদী দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য দেন। এরপর তিনি উচ্চ আদালত থেকে স্থায়ী জামিন নেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, তৌফিক ইমরোজ চারটি ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে ৪২ কোটি টাকা জমা রেখেছেন, যার ‘বৈধ কোনো উৎস দুদক পায়নি। ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এলআর গ্লোবাল বিডিনিউজে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তাৎক্ষণিকভাবে ওই ‘বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিরত’ থাকার নির্দেশ দেয়।
এদিকে এলআর গ্লোবালের বিনিয়োগকৃত টাকা খালিদী ‘অবৈধ প্রক্রিয়ায়’ অর্জন করেছেন বলে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করে করে দুদক। এরপর তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ‘অবরুদ্ধ’ করা হয়।
দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার নামে থাকা কোম্পানির ২০ হাজার শেয়ার ২৫ কোটি টাকায় এবং আরও ২০ হাজার নতুন শেয়ার ইস্যু করে ২৫ কোটি টাকায় এলআর গ্লোবাল বাংলাদেশের সিইও রিয়াজ ইসলামের কাছে বিক্রি করেছেন। ওই ৪০ হাজার শেয়ারের প্রকৃত মূল্য শেয়ার প্রতি ১০০ টাকা হিসেবে ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু ১২ হাজার ৪০০ টাকা প্রিমিয়ামসহ প্রতিটি শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ টাকায়। এই প্রক্রিয়ায় এল আর গ্লোবাল ‘পাবলিক মানি’ তছরুপ করেছে।
তবে দুদকের শুনানিতে তৌফিক ইমরোজ খালিদী দাবি করেন, ব্র্যাক-ইপিএল নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিডিনিউজের অ্যাসেট ভ্যালুয়েশন করে এবং তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ভ্যালুয়েশন দাঁড়ায় ৩৭১ কোটি টাকা।
তবে প্রতিবেদনটিকে ভুয়া বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করে দুদক। ব্র্যাক ইপিএলের সিইও এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা লিখিতভাবে দুদককে জানায়, বিডিনিউজে তারা এ ধরনের প্রতিবেদন জমা দেননি।
দুদক এজাহারে অভিযোগ করে, ওই ৫০ কোটি টাকার মধ্যে ৪২ কোটি টাকাই খালিদীর ব্যাক্তিগত বিভিন্ন হিসাবে জমা করা হয়। অসাধু উপায়ে অর্জন করায় এটা তার জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
এদিকে এন কে রায়ের অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, লায়াবিলিটিসহ বিডিনিউজের সম্পদমূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা। এটি কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়। তা ছাড়া এটি স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানও নয়।
এরপরেও তৌফিক ইমরোজ খালিদী ব্র্যাক ইপিএলের নাম ব্যবহার করে বিডিনিউজের অ্যাসেট ভ্যালুয়েশন করান। ওই মনগড়া মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এলআর গ্লোবাল অস্বাভাবিক এবং কাল্পনিক দামে শেয়ার বিক্রি করে।
আরও পড়ুন…
আগ্রহ ও অনাগ্রহের কোম্পানি
লভ্যাংশ ঘোষণার তারিখ জানিয়েছে ৩ কোম্পানি
বিএসইসির সতর্কতাপত্র্রের কবলে ১৩ ব্রোকারেজ হাউজ
লেনদেনে পুরনোগুলোই নতুন দাপটে