গ্রাহকের রাখা হিসাব থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানত তুলে নিয়েছেন ব্যাংকার। অর্থ তুলে নিতে ব্যাংকের আইটি বিভাগের মাধ্যমে গ্রাহকের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে বসিয়েছেন নিজেরটি। নিজেই চেক তুলে গ্রাহকের অজান্তে তুলে নিয়েছেন পাঁচ কোটি টাকা। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ঘটনাটি উম্মোচিত হয়। এটি ঘটেছে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও মিউচুয়াল ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য। এ-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বনানীর প্রিভিলেজ সেন্টারে যৌথ হিসাব খোলেন ফেরদৌসি জামান নামে এক নারী গ্রাহক। তিনি শাখার তৎকালীন অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) ও সেন্টার ম্যনেজার সরওয়ারের মাধ্যমে ব্যাংক চালু করেন ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল। একই বছরের ২ মে থেকে ৮ মে পর্যন্ত সময়ে তিনটি ভাউচারের মাধ্যমে সাড়ে ছয় কোটি টাকা জমা করা হয় হিসাবটিতে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর একক নামে ব্যাংকটির একই শাখায় আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন ফেরদৌসী জামান। নতুন খোলা হিসাব নম্বরটিতে সেই সাড়ে ছয় কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। এই দুই প্রিভিলেজ অ্যাকাউন্ট তৎকালীন এ প্রিভিলেজ সেন্টারের ম্যানেজার জাহিদ সারোয়ারের তত্ত্বাবধানে খোলা হয়। আমানতের পরিমাণ শাখা অনুযায়ী বিশেষ পরিমাণের হওয়ায় দুটি হিসাবের রিলেশনশিপ ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন জাহিদ সারোয়ার।
হিসাব চালু হওয়ার পরে এর বিপরীতে চেক বই ইস্যু করতে অথরাইজেশন (চেক বইয়ের জন্য আবেদন) কাগজে স্বাক্ষর করে নেন ব্যাংকার জাহিদ সারোয়ার। কিছুদিন পরে নিজ হিসাব থেকে অর্থ তুলতে ব্যাংকে যান ফেরদৌসি জামান। তখন ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। বিষয়টি তিনি শাখা ব্যবস্থাপককে অবহিত করেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। পরে মিউচুয়াল ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে জানানো হয়। ঘটনা তদন্ত করে গ্রাহকের কাছে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা খোয়া যাওয়ার সব দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে ব্যাংক।
সমুদয় অর্থ গ্রাহককে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ব্যাংক। তবে শর্ত দেয়া হয় ঘটনাটি কোথাও প্রকাশ না করতে। গ্রাহকও আশ্বস্ত হয়ে অপেক্ষা করেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ব্যাংক অর্থ ফেরত দেয়নি। উপায় না পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হন গ্রাহক ফেরদৌসি।
অভিযোগ পেয়ে মিউচুয়াল ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়্যাল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি)।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির উত্তরে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। পরে জালিয়াতির বিষয়ে বিশেষ তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আরও পড়ুন…লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের কর-পরবর্তী মুনাফা বেড়েছে ৯২%
কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখতে পায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকটির নিজস্ব তদন্তেই এ জালিয়াতির জন্য শাখার তৎকালীন অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) ও সেন্টার ম্যনেজার সরওয়ারকে অভিযুক্ত করা হয়। এমনকি গ্রাহকের অজ্ঞাতে হিসাবে প্রদত্ত মোবাইল নম্বরটিও পরিবর্তন করা হয় আইটি বিভাগের সহযোগিতায়।
মিউচুয়াল ব্যাংকের বনানী শাখার সিসি টিভি ফুটেজ যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে দেখা যায়, গ্রাহকের নামে বরাদ্দ হওয়া চেক বই ব্যবহার করে সকল টাকা তৎকালীন এভিপি সরওয়ার উত্তোলন করে নেন। হিসাবের লেনদেনের তথ্য পাওয়ার জন্য গ্রাহক একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে এসএমএস সার্ভিসও চালু করেন। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর এসএমএস সার্ভিসের মোবাইল নম্বর পরিবর্তনের জন্য ফেরদৌসী জামানের ‘স্বাক্ষরে’ একটি আবেদন জমা পড়ে, এটি ব্যাংক কর্মকর্তা জাহিদ সারোয়ার স্বাক্ষর ও সিল দিয়ে গ্রহণ করেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে বিআরপিডির একটি সার্কুলার রয়েছে। আমানতকারীর অর্থ যদি ব্যাংককর্মীর মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎই ব্যাংক সমুদয় অর্থ গ্রাহককে ফেরত দিতে বাধ্য। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে পেরেছে। গ্রাহক হয়রানির প্রতিকার পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক এজন্য একটি বিভাগও চালু করেছে।’
আরও পড়ুন…পুঁজিবাজারে লুব-রেফের ব্যতিক্রমী রেকর্ড!
জানা গেছে, পরে ঘটনাটি দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়। দুদকের পক্ষ থেকে সেই স্বাক্ষর হস্তলিপি বিশারদ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে, এ স্বাক্ষর ফেরদৌসী জামানের নয়। নতুন নম্বরটিও ফেরদৌসি জামানের নয়। গ্রামীণফোন থেকে পাওয়া তথ্যমতে পরিবর্তিত মোবাইল নম্বরটি জাহিদ সারোয়ারের নামে নিবন্ধন করা। নতুন চেক ইস্যু করে সেখানে স্বাক্ষর করে চার কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নেন জাহিদ সরোয়ার। ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এ অর্থ উত্তোলন করা হয়। এর পর ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর থেকে তিনি ব্যাংকে আসেননি। এ ঘটনায় তাকে ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করেন।
দুদকে মামলা করার পরও মিউচুয়াল ব্যাংক গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেয়নি। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার লেটার নং-০৩-এর লঙ্ঘন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়, ‘চেক জাল করে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ জালিয়াতি বা প্রতারণার ঘটনায় ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছে বলে প্রমাণিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকের এতৎসংক্রান্ত দাবি পূরণ করতে হবে।’
ব্যাংকটি তা মানেনি। পরে নীতিমালা মানতে মিউচুয়াল ব্যাংকে নির্দেশনা পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন নির্দেশনা পেয়ে গ্রাহকের আত্মসাৎ হওয়া পাঁচ কোটি ১৬ লাখ ৯ হাজার ৫৫৯ টাকা ফেরত দেয় মিউচুয়াল ব্যাংক। নির্দেশনা বাস্তবায়নের পক্ষে প্রমাণাদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে আসে, জাহিদ সরোয়ার এই অর্থ পাঠান তার প্রেমিকা ফারহানা হাবিবের মালিকানাধীন আশা ক্রিয়েশনের (প্রতিষ্ঠান) নামের ব্যাংক হিসাবে। হিসাবটি ব্র্যাক ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখায় রয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওই প্রেমিকাকেই পরে তিনি বিয়ে করেন। এই টাকা নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ফারহানা। বর্তমানে ব্যাংকার জাহিদ সরোয়ার দেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এ মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় ব্যাংককর্মী ব্যক্তিগতভাবে দায়ী। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে। ব্যাংকার পলাতক হলেও গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিয়েছে ব্যাংক।’
আরও পড়ুন…
ডিসেম্বর ক্লোজিং ১১২ কোম্পানির লভ্যাংশ ঘোষণার অপেক্ষায় বিনিয়োগকারীরা
বড় অঙ্কের বোনাস ঘোষণার পরও দাম ধরে রাখতে পেরেছে
চার কোম্পানি নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা ১৬৪ কোটি টাকা
মুনাফায় বড় ঊর্ধ্বগতি থাকলেও লভ্যাংশে প্রভাব নেই
বেশি বোনাসে ব্যাপক লোকসান যেসব কোম্পানিতে
জেমিনি সি ফুডে বিনিয়োগ করে কপালে হাত
বেশি বোনাসের করুণ ফল