পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি অ্যাপোলো ইস্পাত লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) রাজিব হোসেনের অতি লোভের কারণে ডুবতে বসেছে। তিনি কোম্পানিটি থেকে ৯ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ নানাভাবে আত্মসাৎ করেছেন বলে অ্যাপোলো ইস্পাতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে তথ্য পাচার, প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশসহ নানা অপেশাদার কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে এ চার্টার্ড সার্টিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে সম্প্রতি সিএফও রাজিব হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করে অ্যাপোলো ইস্পাত। সেই মামলায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পুলিশ গত মঙ্গলবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অ্যাপোলো ইস্পাতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন রাজিব হোসেন। কোম্পানির বয়োঃবৃদ্ধ চেয়ারম্যান ও অসুস্থ ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নানা কৌশলে ভুল বুঝিয়ে রাজিব হোসেন নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন বলে কোম্পানিটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কাঁচামাল ক্রয় থেকে শুরু করে পণ্য বিক্রয়সহ কোম্পানির সব লেনদেনে রাজিব কমিশন নিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কোম্পানিতে রাজিবের পরিচিতি ছিল চেয়ারম্যানের কাছের ‘লোক’ হিসেবে। সে কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেন না।
কোম্পানিটির এইচআর কয়েল, সিআর কয়েল আমদানিতেও রাজিব মোটা দাগে কমিশন পেতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এরফলে কাঁচামালের আমদানি ও উৎপাদন খরচ বেশি পড়ত। আর এভাবেই গত প্রায় ছয় বছর ধরে লোকসান দিতে দিতে প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
প্রতিষ্ঠানটির বেশিরভাগ পরিচালকের বয়স ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। বার্ধক্যজনিত কারণে তারা কোম্পানির তেমন খোঁজ নিতে পারেন না। আর এ সুযোগ কাজে লাজিয়ে রাজিব বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন।
অ্যাপেলো ইস্পাতের দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, রাজিব হোসেনের ওপর কোম্পানির আর্থিক ও হিসাব-সংক্রান্ত দায়িত্বভার অর্পিত ছিল। ফলে কোম্পানির সার্বিক পরিচালন কার্যক্রম ও আর্থিক কর্মকাণ্ড তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো। এসব ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি ও অনিয়মনের আশ্রয় নিয়ে অসৎ উপায়ে নিজে লাভবান হয়েছেন রাজিব। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে অ্যাপোলো ইস্পাত।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, রাজিব হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় পরোয়ানা থাকায় গত মঙ্গলবার রাতে গুলশানের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বুধবার তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। শুনানি শেষে আদালত রাজিবের দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
২০১৩ সালে অ্যাপোলো ইস্পাত পুঁজিবাজার থেকে প্রায় ২২০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। রাজিবের অসততা ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি এ অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। কোম্পানির সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দেয়ার জন্য বোর্ডকে ম্যানেজ করেন রাজিব। অন্যদিকে পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা অর্থ দিয়ে কোম্পানির ঋণ পরিশোধ করার কথা থাকলেও রাজিবের দুর্নীতির কারণে তা আর সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
অ্যাপোলো ইস্পাতের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অ্যাপোলো বড় প্রতিষ্ঠান হলেও দক্ষ ব্যবস্থাপনা ছিল না। ছিল না কোনো বহিঃনিরীক্ষণ। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি ও জালিয়াতিতে মেতে উঠেন রাজিব। ফলে গুলশানের ফ্ল্যাট, ঢাকার বাইরে জমিসহ বিশাল সম্পদের মালিক বনে যান রাজিব। এদিকে রাজিব সম্পদশালী হলেও ধীরে ধীরে অ্যাপোলো ইস্পাত রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক যোগদানের পর বিষয়টি তার নজরে আসে। তিনি রাজিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেন।
অ্যাপোলো ইস্পাতের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিক এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রাজিব হোসেন অনৈতিকভাবে কোম্পানির ৯ কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংক কোম্পানির নামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন। এসব ঋণ সঠিকভাবে পরিচালনা করেননি তিনি। তার এ অপেশাদারসুলভ কর্মকাণ্ডের কারণে কোম্পানি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়েছে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কোম্পানি। এখন আইনানুগভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করা হচ্ছে।’