শতভাগ বা তার চেয়ে বেশি বোনাস শেয়ার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শেয়ারের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ার ঘটনায় টাকা হারিয়েছেন পুঁজিবাজারে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরাও। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং খাতের শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।
২০০৯ সালের পর টানা এক দশক কেবল নগদ লভ্যাংশ দেয়ার পর ২০১৮ সালের জন্য ব্যাংকটি এক বছরেই দেড় শ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। আর এই সিদ্ধান্ত যেকোনোভাবেই আগেই ফাঁস হয়ে যায়। আর ৯০ টাকার ঘরের শেয়ারের দাম বেড়ে ২২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
পরের বছর কোম্পানিটি আবার ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। কিন্তু তখন শেয়ারের দাম সেভাবে বাড়েনি, উলটো বছরজুড়েই বানরের বাঁশ বাওয়ার মতো করে ওঠানামা করতে করতে পড়তির দিকেই ছিল দাম।
যারা ২২১ টাকায় শেয়ারটি কিনেছেন, প্রতি দুটির বিপরীতে তিনটি বোনাস শেয়ার পাওয়ার পর তাদের সমন্বয় করা দাম দাঁড়ায় ৮৯ টাকা। পরের বছর ১০ শতাংশ বোনাস সমন্বয়ের পর দাম দাঁড়ায় ৮১ টাকা। আর এই দুই বছরে শেয়ারসংখ্যা বেড়ে হয় পৌনে তিন গুন।
সোমবার লেনদেন শেষে কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ৬৬ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ যারা ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার নিয়েছেন, তাদের এখন শেয়ারপ্রতি লোকসান ১৪ টাকা ২০ পয়সা।
২০১০ সালের মহাধসের পর ব্যাংকিং খাতে ডাচ-বাংলাই একক বছরে সবচেয়ে বেশি বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। অন্য ব্যাংকগুলো প্রতিবছরই কিছু বোনাস, কিছু নগদ অথবা কেবল বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। এই সংখ্যাটি ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যেই ছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকের ক্ষেত্রে বোনাস শেয়ার দেয়ার কারণ আছে। তাদের ব্যাসেল টু বাস্তবায়নের মূলধন বাড়ানোর প্রয়োজনে বোনাস দিতে পারে। তবে এই শর্ত পূরণ হয়ে গেছে। এখন কোম্পানির বোনাস দেয়ার একটি নীতিমালা প্রয়োজন। কোম্পানি চাইলেই যেন বোনাসে যেতে না পারে, সেটি ১ শতাংশই হোক।’
গত কয়েক বছরে ব্যাংকগুলোতে নগদে লভ্যাংশ বিতরণের প্রবণতা বেড়েছে। সরকার চাইছে এই প্রবণতা আরও বাড়ুক। এ কারণে, নগদে লভ্যাংশ না দিলে রিজার্ভের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে।
তবে গত দুই বছর করোনা পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোকে নগদে লভ্যাংশ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক নিরুৎসাহিত করে আসছে। গত ডিসেম্বরে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি দেড় টাকা হারে লভ্যাংশ দিতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।
ব্যাপক বোনাস শেয়ারে দুইবারই একই চিত্র
ব্যাংকিং খাতে ডাচ-বাংলা দুইবার ব্যাপক হারে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে। দুইবারই শেয়ারের দর ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। কিন্তু পরে লোকসান দেন বিনিয়োগকারীরা।
২০০৭ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৩৯৪ দশমিক ১৭ শতাংশ অর্থাৎ একটি শেয়ারের বিপরীতে প্রায় চারটি বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে ঘোষণা করে।
পরের বছর আরও ৫০ শতাংশ ও ২০০৯ সালে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয় কোম্পানিটি।
২০০৯ সালের লভ্যাংশ ঘোষণা হয় ২০১০ সালের শুরুতে। আর ওই বছর ১০০ টাকা মূল্যমানের শেয়ারের দর সাড়ে তিন হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে ১০ টাকা মূল্যমানে যা ৩৫০ টাকা।
এরপর টানা আট বছর কোম্পানিটি কেবল নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ শেয়ারপ্রতি তিনি থেকে চার টাকা নগদে পেয়েছেন লভ্যাংশ হিসেবে।
প্রতিবছরই লভ্যাংশ ঘোষণার মৌসুমে বোনাস শেয়ার দেয়া হতে পারে, এই ধারণায় দাম কিছুটা বাড়ত, কিন্তু নগদ লভ্যাংশ দেয়ার খবরে দাম পরে কমে যায়। এই প্রবণতার মধ্য দিয়েই চলছিল লেনদেন।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে শতভাগের বেশি বোনাস শেয়ার দেয়ার গুঞ্জন ডালপালা মেলে। আর সেটি সত্যও প্রমাণ হয়।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে ডাচ-বাংলার পরিশোধিত মূলধনই সবচেয়ে কম। ২০১৮ সালে ১৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার ঘোষণার আগে তা ছিল ২০০ কোটি টাকা। ওই বছর তা বেড়ে হয় ৫০০ কোটি টাকা। আর পরের বছর হয় ৫৫০ কোটি টাকা।
গত এক দশক শতভাগ বা তার চেয়ে বেশি বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে যেসব কোম্পানি, তার মধ্যে কেবল বহুজাতিক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও বার্জার পেইন্টসই দাম ধরে রাখতে পেরেছে। এর বাইরে সবগুলোর কোম্পানির দাম লভ্যাংশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ যে চূড়ায় পৌঁছে, তার সঙ্গে সমন্বয়ের পর দাম এখন অনেক কম।
কোনো কোনো কোম্পানির দাম কমতে কমতে অর্ধেক হয়ে গেছে। আরও পড়তে পারত দাম। কিন্তু করোনা সংক্রমণের শুরুতে গত বছরের মার্চে প্রতিটি শেয়ারের সর্বনিম্ন যে মূল্য বেঁধে দেয়া হয়েছে, সেই ফ্লোর প্রাইসের কারণে দাম আর কমতে পারছে না।
এই কোম্পানিগুলো হলো ডেলটা লাইফ, মুন্নু অ্যাগ্রো (আগে ছিল মুন্নু স্টাফলার), স্টাইলক্রাফট, জেমিনি সি ফুড, ফ্যামিলি টেক্সটাইল।
মাত্রাতিরিক্ত বোনাস শেয়ার দিয়ে দরপতনের এই দৌড়ে ব্যতিক্রম বহুজাতিক দুই কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বা বিএটিবিসি আর বার্জার পেইন্টস আর দেশি কোম্পানি ফার্মা এইড।
তবে বহুজাতিক দুই কোম্পানির ক্ষেত্রেও ব্যাপক হারে বোনাস দেয়ার পর উচ্চমূল্যে কেনা শেয়ারের দাম সমন্বয়ের পর লোকসান কাটিয়ে উঠতে দুই বছরের বেশি সময় লেগে গেছে বিনিয়োগকারীদের।
বিএটিবিসি ২০১৮ ও ২০২০ সালের জন্য ২০০ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার দিয়ে পরিশোধিত মূলধন নয় গুণ বাড়িয়েছে।
এই শেয়ারটি ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৮০০ টাকা উঠে যায়। নয়গুণ পরিশোধিত মূলধন হওয়ার পর সেই দামের সঙ্গে সমন্বয় করা দাম দাঁড়ায় ৫৩৩ টাকা। তবে সবশেষ দর ৫৫৬ টাকা।
একইভাবে ২০১৮ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়া বার্জার পরিশোধিত মূলধন ২৩ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৪৬ কোটি করেছে।
বোনাস শেয়ার ঘোষণার পর দাম বেড়ে তিন হাজার টাকা ছুঁই ছুঁই হয়ে যায়। সমন্বয়ের পর দাম হয় দেড় হাজার টাকার আশেপাশে। এখন দাম এক দেড় হাজার টাকার কিছু বেশি।
২০১০ সালে ফার্মা এইড ৫০০ শতাংশ অর্থাৎ একটি শেয়ারের বিপরীতে পাঁচটি বোনাস শেয়ার দেয়ার পর ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ারটি ১৮ হাজার ৭০০ টাকা হয়ে যায়।
সেদিন যারা কেনেন, তাদের সমন্বয় করা দাম পড়ে তিন হাজার ১১৬ টাকা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্য হওয়ার পর সে দাম দাঁড়ায় ৩১১ টাকা ৬০ পয়সা।
বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির দাম দাঁড়ায় ৪২৬ টাকা ৫০ পয়সা।