দেশের প্রথম ইন্স্যুরেন্স ‘সুপার ব্র্যান্ড’ গ্রীন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ক্যাটেগরিতে সম্প্রতি সুপার ব্র্যান্ড অর্জন করেছে গ্রীন ডেল্টা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দেশের শীর্ষস্থানীয় এ নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এক করবর্ষে ২০ কোটি টাকার বেশি আয়কর পরিহার বা ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
৫৫ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে কোম্পানিটি এ বিপুল পরিমাণ আয়কর পরিহার করেছে। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের ২০১৯-২০ করবর্ষের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফারজানা চৌধুরীর ব্যক্তিগত মোবাইলে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা দেয়া হলেও জবাব দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন ও খুদেবার্তা দেয়া হলেও জবাব দেননি। পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে হেড অব কমিউনিকেশন মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে, বিষয়টি তাদের জানা নেই।’
সূত্রমতে, রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-আয়কর শাখার ঢাকা ও চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ২০১৯-২০ করবর্ষের ওপর আয়কর নির্ধারণের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর কমপ্লায়েন্স অডিট (২০২০ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর) সম্পন্ন করেছে। এতে ২৭টি প্রতিষ্ঠানের (ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান) বিপরীতে মোট ১৫৮ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার ৮৪৮ টাকার অনিয়ম উদ্ঘাটন করে, যার মধ্যে গ্রীন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের অনিয়ম উঠে এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম পর্যালোচনা ও পরিহার করা, রাজস্ব বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া এবং সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিত করতে এনবিআরকে রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর সম্প্রতি প্রতিবেদন দেয়া হয়।
সূত্রমতে, এলটিইউতে ২০১৯-২০ করবর্ষে এক হাজার ১৫৯ করদাতার (ব্যক্তি শ্রেণি, কোম্পানি ও অন্যান্য) বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিরীক্ষা করার সময় ১০৬টি করদাতার (ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং, টেলিকমিউনিকেশন, ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিশ্রেণি) মধ্যে নথি সরবরাহ সাপেক্ষে ১০২টি নথির আয়কর বিবরণী পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এলটিইউয়ের অধীনে ২৫টি ব্যাংক, তিনটি মোবাইল কোম্পানি, দুটি টোব্যাকো কোম্পানি, ১১টি নন-ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান, ১০টি মার্চেন্ট ব্যাংক, দুটি জীবন বিমা কোম্পানি, ১১টি সাধারণ বিমা কোম্পানি, পাঁচটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, ২৭টি অন্যান্য কোম্পানি ও ছয় জন ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা রয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রীন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এনবিআরের আওতাধীন এলটিইউ (আয়কর), ঢাকার একটি করদাতা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে আয়কর নথি, বার্ষিক নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী ও অন্যান্য রেকর্ড পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, করদাতা কোম্পানি গ্রীন ডেল্টা আয়কর রিটার্নের সঙ্গে বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করেছে, যাতে (বার্ষিক প্রতিবেদনের নোট-৮.২.৬) ‘ফায়ার, মেরিন, মোটরস, এজেন্সি কমিশন’ বাবদ যথাক্রমে ২৫ কোটি ২৫ লাখ ৯০ হাজার ২৩৫ টাকা, ১৯ কোটি ২৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৭ টাকা, দুই কোটি ৬৭ লাখ ৯৬ হাজার ৮৭৬ টাকা এবং সাত কোটি ৫৪ লাখ ২৪ হাজার ৬৭১ টাকাসহ মোট ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৯ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে।
পুঁজিবাজার তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে যার ওপর করপোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ হিসেবে আয় ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৯ টাকার ওপর প্রযোজ্য আয়কর ২০ কোটি ৫২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৮০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি অননুমোদনযোগ্য ব্যয়কে আয়ের সঙ্গে যোগ না করে এই আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ৩০ (এএ) মোতাবেক এ ধরনের খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসাবে গণ্য এবং মোট আয়ের সঙ্গে যোগযোগ্য। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ৩০ (এএ) ও ধারা ৫৩ (জি) লঙ্ঘন করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, করদাতা কোম্পানি ২০১৯-২০ করবর্ষে ৮২ বিবি ধারায় আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে, যাতে আয় প্রদর্শন করেছে ২৩ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ৯২১ টাকা। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ৫৩(জি) অনুযায়ী, দাবিকৃত খরচের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনযোগ্য। উৎসে কর কর্তনের কোনো প্রমাণ বা কাগজপত্র নিরীক্ষায় না পাওয়ায় আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ৩০ (এএ) মোতাবেক এ খরচ অননুমোদনযোগ্য খরচ হিসাবে গণ্য এবং মোট আয়ের সঙ্গে ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৯ টাকা আয় যোগযোগ্য। সে অনুযায়ী গ্রীন ডেল্টার ওই করবর্ষে মোট আয় ৭৭ কোটি ৯৪ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭০ টাকা, যার ওপর ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর ২৭ কোটি ৮১ লাখ ৫১ হাজার ১৭৪ টাকা।
প্রতিষ্ঠান প্রদর্শিত আয় ২৩ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ৯২১ টাকার ওপর সাত কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার ৫৯৪ টাকা কর পরিশোধ করেছে। কিন্তু আয় ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪৯ টাকার ওপর প্রযোজ্য ২০ কোটি ৫২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৮০ টাকা কর পরিশোধ করেনি। করদাতা কোম্পানি ৮২ বিবি ধারায় আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে বলে উত্থাপিত আপত্তি পরীক্ষা করে পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করতে নিরীক্ষা মন্তব্য এবং পরিহার করা আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা করে প্রমাণসহ নিরীক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ১৯৮৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বতর্মানে এ কোম্পানিটি এ-ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে। সর্বশেষ বছর কোম্পানিটি ১৫ শতাংশ নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দেয়। গত এক বছরের মধ্যে কোম্পানিটি সর্বনিম্ন ৪৪ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৭৩ টাকা ৪০ পয়সায় কেনাবেচা হয়। সর্বশেষ শেয়ারটি ৬০ টাকা ২০ পয়সায় লেনদেন হয়।