গত বছরের ডিসেম্বর থেকে টানা দেড় মাস প্রায় সব খাতের শেয়ারের দর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও ব্যাংক খাতের দর বৃদ্ধি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল পয়সার হিসাবে। আবার দুই সপ্তাহে দর সংশোধনের সময়ও দেখা যায়, বেশির ভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দর কমেছে পয়সার হিসাবে। কোনো কোনোটির দর কমেছে ১০ শতাংশ বা আশেপাশে। তবে অনেক কোম্পানির দর এই সময়ে যেমন ৫০ শতাংশ বেড়েছে, সংশোধনে আবার কমেছেও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই প্রকৌশল খাতের কোম্পানি বিডিঅটোকারের দর বাড়তে থাকে। বছর কয়েক আগেও ১০ টাকার নিচে লেনদেন হতে থাকা দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারদর বাড়তে বাড়তে ৫০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এর পেছনে কী কারণ, সে রহস্য কখনো জানা যায়নি। একপর্যায়ে কোম্পানিটির লেনদেন স্থগিত করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সেটির দর কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ১৪৭ টাকা ৩০ পয়সায়।
দাম আরও কমতে পারত। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে বাজারে যে ধস দেখা দেয়, তখন পতন ঠেকাতে সর্বনিম্ন যে দাম বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়া হয়, সে জন্যই এর চেয়ে নিচে নামতে পারছে না দাম।
২০২০ সালে শেয়ারপ্রতি ৩০ পয়সা লভ্যাংশ দেয়া শেয়ারটির বিষয়ে এই ফ্লোর প্রাইসেও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। বৃহস্পতিবার দুইবারে কেবল ৬১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
একই বছর অস্বাভাবিক বাড়ে মুন্নু স্টাফলারের দাম। ৩৫০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর কোম্পানিটির দাম ওঠে ৫ হাজার ৬৩৪ টাকা।
২০১৮ সালে ৩৫০ শতাংশের পরের বছর ২০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় কোম্পানিটি।
সাড়ে ৫ হাজার টাকায় যিনি কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছেন, তার এখন দাম পড়েছে ২ হাজার ৩৪৫ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হচ্ছে তিন ভাগের এক ভাগেরও কম দামে।
ফ্লোর প্রাইস ৭৯৪ টাকা ৮০ পয়সাতেও এখন ক্রেতা পাওয়া যায় না। সব শেষ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে মাত্র ১২টি।
আড়াই বছর আগে মুন্নু সিরামিকের ৪০ টাকার নিচের শেয়ার ছোটে পাগলা ঘোড়ার মতো। একপর্যায়ে দাম ছাড়িয়ে ১১ গুণ হয়ে যায়।
ওই বছর ৩০ শতাংশ, পরের বছর ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ৫ শতাংশ বোনাস দেয়ার পর এখন দাম পড়ে ২৯৩ টাকা।
প্রায় প্রতিদিন চাহিদার তুঙ্গে থাকা এই কোম্পানিটির শেয়ারেরও চাহিদা নেই ফ্লোর প্রাইসে। ১২৬ টাকা ৮০ পয়সায় কেবল ৯১৫টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে বৃহস্পতিবার।
একইভাবে প্রায় ২ হাজার টাকা উঠে যাওয়া জেমিনি সি ফুডের দাম বিএসইসি ঠেকিয়ে রেখেছে ১৪১ টাকায়।
বছর দুয়েক আগে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি কেপিসিএলের দামও বাড়তে বাড়তে ১৩০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। সেই কোম্পানির তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি বন্ধ হয়ে গেছে; দুটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আগামী মে মাসে। এখন বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত। দামও কমতে কমতে ঠেকেছে ৪৩ টাকায়।
গত কয়েক বছরে পুঁজিবাজারে অনেক কোম্পানির শেয়ার দর নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তলানি থেকে তা আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো কারণ কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না।
দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন শেয়ারের চাহিদাও বেড়ে যায়। একপর্যায়ে দাম কমতে থাকে। আর পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন ফেসবুক পেজে রাগ ঝাড়েন বিনিয়োগকারীরা, যারা আরও বাড়বে ভেবে উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে ধরা খেয়েছেন।
কেউ কেউ বের হন বিপুল পরিমাণ লোকসান দিয়ে, কেউ আবার পরে আবার বাড়বে ভেবে শেয়ার ধরে রাখেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন কখনো আর পূরণ হয় না।
প্রায় সব খাতের শেয়ার নিয়েও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে ব্যতিক্রম বলতে গেলে আছে ব্যাংক খাত।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারে উত্থানের সময় এই খাতের শেয়ারেও ব্যাপক উল্লম্ফন হয়। তবে ধসের পর থেকে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ক্রমেই কমেছে এই খাত নিয়ে।
এই খাতের শেয়ারের দর সেভাবে খুব একটা বাড়েও না, আবার পতন হলেও অন্যান্য খাতের মতো ধপাস করে পড়েও না।
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারের উত্থানের সময়ও এই চিত্র দেখা যায়। টানা দেড় মাস প্রায় সব খাতের শেয়ারের দর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও ব্যাংক খাতের দর বৃদ্ধি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল পয়সার হিসাবে।
আবার দুই সপ্তাহে দর সংশোধনের সময়ও দেখা যায়, বেশির ভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দর কমেছে পয়সার হিসাবে। কোনো কোনোটির দর কমেছে ১০ শতাংশ বা আশেপাশে।
কিন্তু দর সংশোধনে অনেক কোম্পানি দর হারিয়েছে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সমিতি মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘ব্যাংকের শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলেও দাম না বাড়ায় মূলত সে আগ্রহকে ধরে রাখা যায় না। এ ছাড়া পুঁজিবাজারের পোর্টফোলিও ম্যানেজাররাও স্বল্প সময়ে মুনাফা পাওয়া যায় সেগুলোকে বাছাই করেন।’
পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী খন্দকার ফারুক বলেন, ‘বেশ কিছু ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ আছে। পুঁজিবাজার ভালো থাকায় প্রত্যাশা ছিল ব্যাংকের শেয়ারের ও দাম বাড়বে। কিন্ত সে অনুযায়ী বাড়েনি। ফলে মুনাফা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘মুনাফা না হওয়ায় মূলত এ খাতে নতুন বিনিয়োগ করিনি। পুঁজিবাজারের সবচেয়ে শক্তিশালী এ খাতের কেন এত করুণ অবস্থা তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার যাচাই করা উচিত।’
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগকারীরা কিনতে চান না এটা ঠিক নয়; বরং এ খাতে মুনাফা না থাকায় আগ্রহ হারান বিনিয়োগকারীরা।’
তিনি বলেন, ‘নানা কারণে ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়ে না। এ সময় ব্যাংকগুলো বোনাস লভ্যাংশ দিয়ে পরিশোধিত মূলধন বাড়িয়েছে। এমনও ব্যাংক আছে যাদের শেয়ার শত কোটির বেশি। ফলে এক-দুই দিন শেয়ার কিনে এ খাতের শেয়ারের দর বাড়ানো সম্ভব হয় না।’
গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি মুনাফা দিয়েছে ব্যাংক। এমনও ব্যাংক আছে সেগুলো ব্যাংকে এফডিআরের চেয়ে বেশি মুনাফা দিয়েছে। এমন অন্তত ১০টি ব্যাংক আছে, যাতে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়েছেন।
বর্তমানে এফডিআরের মুনাফা ৬ থেকে ৭ শতাংশে নেমেছে। তার শেয়ার দরের সঙ্গে তুলনা করে নগদ মুনাফার যে ইল্ড, তা ১৬ শতাংশও দিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক।
নড়চড় কম
আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের দর দীর্ঘ সময় পড়ে থাকলেও গত ১৮ জানুয়ারি মাসের সর্বোচ্চ দর ওঠে ২৩ টাকায়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত এ দামের শেয়ার বিক্রির সুযোগ পাননি বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে ব্যাংকের শেয়ার ২২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে।
ব্যাংক এশিয়ার শেয়ার গত ১৪ জানুয়ারি মাসের সর্বোচ্চ দর ওঠে ১৮ টাকা ০১ পয়সা। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ১৬ টাকা ৪০ পয়সায়।
ব্র্যাক ব্যাংকের গত এক মাসে সর্বোচ্চ দর উঠেছে ১৭ জানুয়ারি ৫১ টাকা ১০ পয়সা। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ৪৯ টাকায়।
সিটি ব্যাংকের একই দিনে মাসের সর্বোচ্চ দর ছিল ৩৩ টাকা ১০ পয়সা। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ৩০ টাকা ৩০ পয়সায়।
ঢাকা ব্যাংকের শেয়ারের গত জানুয়ারির শেষ দিকে মাসের সর্বোচ্চ দর উঠে ১৩ টাকায়। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ১২ টাকায়।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শেয়ারের মাসের সর্বোচ্চ দর ৭০ টাকা ২০ পয়সা ওঠে গত ১৭ জানুয়ারি। তারপর আর এই দামে আসেনি। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ৬৩ টাকা ৯০ পয়সায়।
ইস্টার্ন ব্যাংকের মাসের সর্বোচ্চ দর ওঠে ১৮ জানুয়ারি ৩৯ টাকা ০২ পয়সা। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ৩৭ টাকা ৬০ পয়সায়।
এক্সিম ব্যাংকের মাসের সর্বোচ্চ দর ওঠে ২১ জানুয়ারি ১৩ টাকা ০২ পয়সা। তরপর আর দাম বাড়েনি। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ১২ টাকায়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ারের সর্বোচ্চ দর ছিল গত এক মাসে ৯ টাকা ৬০ পয়সা। ১৭ জানুয়ারির পর এ ব্যাংকের শেয়ারের দর আর বাড়েনি। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ৮ টাকা ৬০ পয়সায়।
এনসিসি ব্যাংকের শেয়ারের দর গত এক মাসে সর্বোচ্চ হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি। তখন দর ওঠে ১৪ টাকা ৪০ পয়সা। সে সময় এই ব্যাংকের শেয়ার কিনে এখনো মুনাফার অপেক্ষায় বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে ১৩ টাকা ৬০ পয়সায়।
এসআইবিএলের মাসের সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ২১ জানুয়ারি ১৪ টাকা ২০ পয়সা। এই ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে এখনো মুনাফা পাননি বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে এসআইবিএলের শেয়ার লেনদেন হচ্ছে ১৩ টাকা ২০ পয়সায়।
কী হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি
চলতি বছরের শুরুতে পুঁজিবাজার ২০১০ সালের মহাধসের পর চাঙা অবস্থায় ফিরে আসে। প্রায় প্রতিদিনই লেনদেন হয়েছে ১ থেকে ২ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে সর্বোচ্চ লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তার মধ্যে ১৭ জানুয়ারিও পুঁজিবাজারে লেনদেন হয় ২ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।
লেনদেনের এমন অবস্থায় দাম বাড়ে ব্যাংকের শেয়ারের। সেদিন তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে কমেছে চারটির দর। অপরিবর্তিত ছিল তিনটি। আর বাড়ে বাকি ২৩টির দর।
সবচেয়ে বেশি দর বাড়া ১০টি কোম্পানির পাঁচটিই ছিল ব্যাংকের। দর বাড়ার এমন অবস্থার পর আগ্রহী হন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু সেদিনের পর ব্যাংকের শেয়ারের দর আর বাড়েনি। এখন শুধুই কমছে।