নানা সময় দেখা গেছে, নতুন শেয়ার এলেই কোম্পানির মৌলভিত্তি, শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ও আয়, লভ্যাংশ দেয়ার সম্ভাবনা, এসব বিচার বিবেচনা না করেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন বহু বিনিয়োগকারী। আর এই হুলস্থুল শেষে দাম কমে এলে তাদের অর্থ আটকে যায় দীর্ঘ দিনের জন্য। কেউ কেউ বড় লোকসান দিয়ে বের হন।
বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর রবি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর হুলস্থুল। টানা ১৩ কার্যদিবস শেয়ারের দর বেড়েছে এক দিনে যত বাড়া সম্ভব ততই।
১০ টাকায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার দর সাত গুণ হতে সময় নেয়নি দুই সপ্তাহ। কিন্তু এরপরেই ছন্দপতন।
৭১ থেকে ৫১ টাকায় নেমে আসতেও সময় লাগেনি। ২৮ শতাংশ দর হারিয়ে ফেলার পর এই শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক পেজে রাগ ঝাড়ছেন।
একই ঘটনা ঘটেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি এনার্জি প্যাক পাওয়ারের ক্ষেত্রে।
বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ৩৫ টাকা ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৩১ টাকা দরে আইপিওতে পেয়েছেন শেয়ার।
সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন শুরু হতেই এই কোম্পানি নিয়েও হুলস্থুল। এক সপ্তাহের মধ্যেই দাম বেড়ে উঠে যায় ১০১ টাকায়।
সেখানেও রবির চিত্র। যেদিন ১০১ টাকা দাম উঠে, সেদিনই দাম কমে ৮২ টাকায় নেমে যায়। এরপর আরও কমতে কমতে সবশেষ দাম ৬৫ টাকা ৯০ পয়সা।
বিএসইসির নিয়ম অনুযায়ী, লেনদেনের প্রথম দিন শেয়ারের দর বাড়তে পারবে ৫০ শতাংশ, দ্বিতীয় দিনে বাড়তে পারবে ৫০ শতাংশ। তৃতীয় দিন থেকে স্বাভাবিকভাবে ১০ শতাংশ করে শেয়ারের দর বাড়ে।
সম্প্রতি যেসব কোম্পানি প্রাথমিক গণ প্রস্তাব বা আইপিও করে টাকা তুলেছে, তার প্রায় সবগুলো ক্ষেত্রে এই হারেই দাম বেড়েছে প্রথম কয়েক দিন।
নানা সময় দেখা গেছে, নতুন শেয়ার এলেই কোম্পানির মৌলভিত্তি, শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ও আয়, লভ্যাংশ দেয়ার সম্ভাবনা, এসব বিচার বিবেচনা না করেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন বহু বিনিয়োগকারী। আর এই হুলস্থুল শেষে দাম কমে এলে তাদের অর্থ আটকে যায় দীর্ঘ দিনের জন্য। কেউ কেউ বড় লোকসান দিয়ে বের হন।
এই অবস্থায় আজ পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু করতে যাচ্ছে অবকাঠামো খাতের কোম্পানি মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড।
বুকবিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৫৪ টাকায় পেয়েছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন ৬০ টাকায়।
বিএসইসির নীতিমালা অনুযায়ী প্রথম দিন এটি সর্বোচ্চ ২৭ টাকা বাড়তে পারবে, অর্থাৎ ৮১ টাকায় বিক্রি হওয়া সম্ভব। পরের দিন বাড়তে পারবে ৪০ টাকা ৫০ পয়সা অর্থাৎ সর্বোচ্চ দাম হতে পারবে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা।
লেনদেন শুরুর আগের দিন মীর আক্তারের প্রকাশ করা আর্থিক বিবরণ অনুযায়ী, চলতি বছরের ছয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি আয় হয়েছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। আর শেয়ার প্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ৪০ টাকা ৬১ পয়সা।
বিনিয়োগকারীরা আয়, সম্পদ মূল্য, লভ্যাংশের সম্ভাবনা বিচার বিশ্লেষণ করেন কি?
রবি ও এনার্জি প্যাকের ক্ষেত্রেও বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় ও সম্পদমূল্য কতটা বিবেচনা করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
রবি পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর সময় দুই প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি আয় ছিল চার পয়সা। শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ১২ টাকা ৬৪ পয়সা।
অন্যদিকে এনার্জিপ্যাক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার প্রথম প্রান্তিকে পর ডায়ালুটেড ইপিএস (শেয়ার প্রতি আয়) ৩৫ পয়সা। ডায়ালুটেড শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ৪৮ টাকা ৭৪ পয়সা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমদে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে তারা আগে থেকেই বাট্টাকৃত দরের বেশি দামে শেয়ার কিনে থাকেন। প্রথম দিন ৫০ শতাংশ বাড়লে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে তা আরও কম বাড়ে। ফলে তারাও ভালো লাভের আশায় শেয়ার ছাড়তে চান না।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নতুন কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। এবং কখন শেয়ার কিনতে হবে সেটা কোম্পানির আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কেনা উচিত।’
২০১৯ সালে তালিকাভুক্ত রানার অটোমোবাইলের শেয়ার কিনে বিপুল পরিমাণ লোকসানে বিনিয়োগকারীরা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ৭৫ টাকায় ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৬৭ টাকায় যে শেয়ার পেয়েছেন, সেটির দাম কয়েক দিনেই উঠে যায় ১১১ টাকা ৬০ পয়সায়।
বেশি দামে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনেন ভালো মুনাফার আশায়। কিন্তু প্রথম বছরে শেয়ার প্রতি এক টাকা নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস শেয়ার ও দ্বিতীয় বছর আবার এক টাকা নগদ মুনাফা দিয়েছে রানার।
এখন শেয়ারের দাম কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা ৬০ পয়সা।
গত ১ ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন হচ্ছে ডমিসেন স্ট্রিল বিল্ডিং লিমিটেড। কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরুর পর মাত্র ১০ কার্যদিবসে ১০ টাকার শেয়ারের দর পৌঁছে সাড়ে ৪৩ টাকায়। বর্তমানে দাম কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ টাকায়।
২০ ডিসেম্বর লেনদেন শুরু করে বিমা খাতের কোম্পানি ক্রিস্ট্যাল ইন্স্যুরেন্স। এই খাত নিয়ে এখন বাজারে চলছে নানা আলোচনা। প্রায় সব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।
বিমা খাতের চাঙ্গাভাবের মধ্যে এক্সপ্রেস ইন্সুরেন্সের দাম লেনদেন শুরুর ১৩ দিনে উঠে যায় ৫৪ টাকায়। সেটিও কমে এখন লেনদেন হচ্ছে ৪৩ টাকায়।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ ডিএসই পরিচালক শাকিল রিজভী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যেসব কোম্পানির শেয়ারের দর প্রথম বেড়ে আর বাড়ে না সেসব কোম্পানির ভালো নামে তালিকাভুক্ত হলেও আসলে তাদের ফান্ডমেন্টাল ভালো না। তাই বিনিয়োগকারীদেরও কোম্পানি সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এসব কোম্পানির ক্ষেত্রে যারা ইস্যু নিয়ে আসে তাদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে থাকা উচিত।’
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম সম্প্রতি এক কর্মশালায় বলেন, ‘এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্ভিলেন্স সিস্টেম অনেক শক্তিশালী।’
এক উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি রবির শেয়ার কেনার জন্য একটি ব্রোকারেজ হাউজ থেকে পাঁচ লাখ শেয়ারের ক্রয় আদেশ আসে। আমরা সার্ভিল্যান্সে তা দেখে সেই ব্রোকার হাউজে বিও হিসাবের তথ্য চাই। পাশাপাশি যে বিও হিসাবে থেকে অর্ডার এসেছে সেই হিসাবের লেনদেনের তথ্য চাই। এমন নজরদারির কিছুক্ষণ পর সেই অর্ডারটি উঠিয়ে নেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত ক্রয় আদেশ দেখিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য কারসাজিকারীরা এমনটি করে থাকে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আমরা সব কিছুই নজরদারি করছি।’