পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত পোশাক খাতের একটি প্রতিষ্ঠান ফ্যামিলি টেক্স লিমিটেড। প্রথমদিকে মুনাফায় থাকলেও গত কয়েক বছরে উদ্যোক্তাদের ব্যর্থতা, দ্বন্দ্ব, অদূরদর্শিতা, অপব্যবস্থাপনায় লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়। আর প্রতি বছর কমছে উৎপাদন, বাড়ছে দেনার পরিমাণ। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের বেশিরভাগ শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
জানা যায়, চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) একটি প্রতিষ্ঠান ফ্যামিলি টেক্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৬ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে। আর ২০১৩ সালে বাজারে তালিকাভুক্ত হয় ফ্যামিলি টেক্স। লেনদেন শুরুর দিন প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ দাম ছিল ৪৮ টাকা ৫০ পয়সা। আর গতকাল তা ২ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন হয়। সেই হিসাবে একজন বিনিয়োগকারী শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছেন ৪৫ টাকা ৮০ পয়সা। তখন (২০১৪) নিট মুনাফা হয়েছিল ১৩৮ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের (২০১৯-২০) নিট লোকসান পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে উদ্যোক্তাদের ব্যর্থতা, দ্বন্দ্ব, অদূরদর্শিতা, অপব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর কমছে উৎপাদন, বাড়ছে দেনার পরিমাণ। এর মধ্যে ফ্যামিলি টেক্সের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেরাজ-ই-মোস্তফা গত ২০১৮ সালের অক্টোবরের তার নিজ নামের ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার শেয়ার বিনা ঘোষণায় বিক্রি করেছেন, যা ওইদিনে ডিএসইতে কোম্পানিটির বিক্রি হওয়া শেয়ারের প্রায় ৯৩ শতাংশ।
ডিএসইতে ওইদিন ১ কোটি ৮২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৭টি শেয়ার বিক্রি হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আরেক পরিচালক রোকসানা মোরশেদ ৯২ লাখ ৪০ হাজার শেয়ার সাড়ে সাত কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন। পাশাপাশি তিনি সিএনএ টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। রোকসানা মোরশেদ ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে চার দফায় ৫ কোটি ১৮ লাখ শেয়ার প্রায় ৫৬ কোটি টাকায় বিক্রি করেন। শুধু রোকসানা মোরশেদই নন, তার সাবেক স্বামী ও ফ্যামিলি টেক্সের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদও একই সময়ে (২০১৭) অক্টোবরে সোয়া ২৩ কোটি টাকার বিক্রি করেন। পরে মোহাম্মদ মোরশেদ দেশের বাইরে চলে যান। ফলে ন্যূনতম শেয়ার ধারণ করতে ব্যর্থ হয় পরিচালনা পর্ষদ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন করেছে সিকিউরিটিজ রুল ও আইন।
তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের নিট লোকসান হয় পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রয় ছিল ৬২ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ছিল ৫৭ কোটি টাকা এবং বিক্রয় ও প্রশাসনিক ব্যয় ছিল তিন কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এতে পরিচালন মুনাফা হয়েছিল এক কোটি ২৫ লাখ টাকা; যা আগের অর্থবছরের ছিল দুই কোটি আট লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রতিষ্ঠানটির মোট বিক্রয় ছিল ৯৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আর বিক্রীত পণ্যের ব্যয় ছিল ৯১ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং বিক্রয় ও প্রশাসনিক ব্যয় ছিল পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে নিট লোকসান হয়েছিল দুই কোটি ৮১ লাখ টাকা। এছাড়া গত ৩০ জুন ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকঋণ ছিল প্রায় ৩২ কোটি টাকা; যা আগের অর্থবছরের ছিল ১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকঋণ বেড়েছে ১৩ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, উদ্যোক্তা পরিচালকদের ঘোষণাবিহীন বা গোপনে শেয়ার কেনাবেচা হচ্ছে কি না, তা কঠোরভাবে নজরদারির ব্যবস্থা বিএসইসির নেই। স্টক এক্সচেঞ্জ বিচ্ছিন্নভাবে এ বিষয়টি নজরদারি করে এবং বিএসইসিকে তথ্য দেয়। কিন্তু সংস্থাটি ত্বরিত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে এমন নজির খুব কম।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ ই মোস্তফা শেয়ার বিজকে বলেন, ফ্যামিলি টেক্স শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। করোনা পরিস্থিতির কারণে পোশাক রপ্তানি অনেক কমেছে। এরপরও আমরা অনেক চেষ্টা করছি ঘুরে দাঁড়াতে। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করছেন। যদিও একসময়ে আরও বেশি শ্রমিক ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে আসলে কী ধরনের পরিকল্পনা করব তাও বুঝতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় এপ্রিল-মে’এ দিকে অনেক বেশি কার্যাদেশ আসতে পারে। যেহেতু তাদের আগের অর্ডারে নেয়া পণ্য শেষ হচ্ছে।
পরিচালনা পর্ষদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণ বিষয়ে তিনি বলেন, তখন আসলে ফান্ড জোগানোর জন্য আমি শেয়ার বিক্রয় করি। আর পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আমাদের চিঠিপত্র দিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ শেয়ার কিনতে পারব, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। যদি প্রতিষ্ঠানকে ওসিটি মার্কেটে পাঠিয়ে দেয়, তখন তো ২৫ হাজার বিনিয়োগকারী বিপাকে পড়বেন এ বিষয়ে তিনি বলেন, নিশ্চয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা তো একসময়ে ভালো মুনাফায় ছিলাম। এখন লোকসানে আছি। ব্যবসায় তো লাভ-লোকসান থাকে।
পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান ফ্যামিলি টেক্সটাইল লিমিটেডের অনুমোদিত মূলধন ৪০০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ৩৫৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ার সংখ্যা ৩৫ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার ৩৮৮টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের চার দশমিক দুই শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৭৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ শেয়ার আছে।