মহামারি কভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধে বাজারে এসেছে দুই কোম্পানির টিকা। প্রক্রিয়াধীন আছে আরও মডার্নাসহ কয়েকটি। চাহিদার কথা চিন্তা করে অনেকটা জবরদস্তি করে বাজারে ছাড়া হয়েছে এই টিকা। এ কারণে টিকা নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক ও আস্থাহীনতা। বিশেষ করে টিকার কার্যকাল এবং সফলতা নিয়ে মানুষ দ্বিধায় পড়েছে। পোলিও, হাম, র্যাবিস, হেপাটাইটিস প্রভৃতি টিকা জীবনে একবার দিলেই হয়। কিন্তু মানব দেহে কভিড-১৯-এর টিকার কার্যকারিতা হবে সর্বোচ্চ এক বছর। তাই নভেল করোনা প্রতিরোধে প্রতি বছর টিকা দিতে হবে।
এদিকে টিকার বাজারজাত নিয়ে অনেক প্রচার থাকলেও টিকার কার্যকাল নিয়ে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো নিশ্চুপ। এটাই ভাবিয়ে তুলছে সংশ্লিষ্টদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রতি বছরই টিকা নিতে হবে। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, রোগটির বয়স মাত্র এক বছর। অন্যান্য টিকার মতো দীর্ঘ সময় নিয়ে ট্রায়াল শেষে চুড়ান্ত ফল বের করা হয়নি। অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই টিকা বাজারজাত করা শুরু হয়েছে। যা মানব দেহে প্রয়োগ করাও হচ্ছে। এজন্য গবেষকরা আপাতত এক বছর কার্যকর থাকবে ধরে নিয়েই এগোচ্ছেন।
কভিড-১৯-এর টিকা আবিষ্কারের পথে রয়েছে শতাধিক প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত তিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টিকা আবিষ্কার করেছে। এর মধ্যে ফাইজার ও অক্সফোর্ডের টিকা বাজারজাত শুরু হয়েছে। আর মডার্নার টিকা আসার পথে আছে। মানব দেহে এ টিকাগুলোর কার্যকারিতা এক বছর ধরা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড ও ব্রিটিশ-সুইডিশ মালিকানাধীন বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসি যৌথভাবে টিকা আবিষ্কার করে। এর নাম দেয়া হয়েছে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা। এটির কার্যকারিতাও এক বছর। তবে অক্সফোর্ডের টিকার ডোজ দিতে হবে দুটি করে।
টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে কয়েকটি দেশও। কানাডা আরও দুই কোটি ডোজের ক্রয়াদেশ দিয়েছে, যা আগামী বসন্ত অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে প্রয়োগ করার প্রস্তুতি নিয়েছে কানাডা সরকার। তবে মডার্নার তৈরি টিকা দেরিতে পাবে বলে ফাইজারের টিকা নিয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো। এছাড়া ভারতে অক্সফোর্ডের টিকা গতকাল প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও আগামী মাসে এ টিকা প্রদান শুরু হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
এদিকে কয়েকটি দেশে করোনা টিকা প্রয়োগের পর ইতোমধ্যে মারা যাওয়ার খবর এসেছে। এর মধ্যে নরওয়েতেই ২৩ জন মারা গেছে ফাইজারের টিকা গ্রহণের পর। টিকা নেয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে জ্বর, ডায়রিয়া, সারা দেহে ব্যথা, ঘাম, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে খিচুনির মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছে। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়ছে। তাই ভ্যাকসিন বা টিকাকে নিরাপদ মনে করছেন না অনেকেই।
টিকা ভীতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল গালিব স্ট্যাটিকা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে তথ্যটি প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে, গড়ে ২০ থেকে ৩৩ শতাংশ মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে টিকা নিরাপদ নয়। এর মধ্যে রাশিয়ায় ২৪ শতাংশ, সুইজার ল্যান্ড ২২ শতাংশ, আর্মেনিয়া ২১ শতাংশ ও ফ্রান্সের ৩৩ শতাংশ মানুষ টিকাকে নিরাপদ বলে বিশ্বাস করে না।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী, কোনো টিকা আবিষ্কারের পর তা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিতে হয়। এরপর কিছু মানুষের ওপর প্রয়োগ করে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তার প্রভাব, প্রতিক্রিয়া ও ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক আচরণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সমাধান শেষে নতুন করে পুনরায় পরীক্ষা চালাতে হয়। চুড়ান্তভাবে টিকার প্রয়োগ করতে একযুগ বা ১২ বছর সময় লাগে। কিন্তু পর্যাপ্ত গবেষণা ছাড়াই অনেকটা জোর-জবরদস্তি করেই করোনা টিকা বাজারে আনা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
টিকার কার্যকারিতা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্টিভেন কেফুট বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এ ধরনের সংক্রামকের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষের ওপর এটি কয়েক বছর পর্যন্ত ভালোভাবে কার্যকর থাকে। তাদের রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রাখতে ভ‚মিকা পালন করে। এ টিকা প্রয়োগের ১০ বছরের কোনো অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকরা শুধু একটি অনুমান বা ধারণা করতে পারেন মাত্র।’ এ ধরনের ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি ও আচরণ এবং প্রতিষেধক টিকার কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে শুধু একটি ধারণা দেয়া যেতে পারে কভিড-১৯ টিকা কতদিন কার্যকর থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
টিকার কার্যকারিতা নিয়ে বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ‘টিকার কার্যকারিতা কতদিন হবে, তা আপেক্ষিক। তবে এ টিকার কার্যকারিতা ছয় মাস থাকবে মানব শরীরে। অর্থাৎ ছয় মাস পার হলেই পুনরায় টিকা নিতে হবে।’
কয়েকটি গবেষণা ইতোমধ্যে জানিয়েছে, কভিড-১৯ রোগ সারলেই টিকার মাধ্যমে উৎপাদিত এন্টিবডি শেষ হয়ে যাবে। কিছু গবেষণা বলছে, রোগ সারার আরও কিছুদিন কার্যকর থাকবে এন্টিবডি। কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক টিকার কার্যকারিতা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গত অক্টোবরে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, এন্টিবডি কমপক্ষে ১১৫ দিন বা প্রায় চার মাস থাকবে মানব দেহের রক্তে ও স্যালিভা বা মুখের লালায় স্থিতিশীল অবস্থায় থাকবে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্স উল্লেখ করেছে, মার্কিন একটি গবেষণা সংস্থা বলেছে, এন্টিবডি তৈরিতে টিকার কার্যকারিতা কমপক্ষে আট মাস থাকবে।
কেফোট মনে করেন, ‘কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের সময় অতিক্রম করেছে মাত্র ১২ মাস। এই সময়ের মধ্যে টিকার কার্যকারিতা বলা দুষ্কর। আমরা হাইপোথেসিস বা এক প্রকার অনুমান করতে পারি মাত্র। তবে আমার মনে হয়, এন্টিবডি দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে করোনা মুক্ত হওয়ার পরে। কিন্তু এন্ডিবডি শেষ হয়ে গেলেও এটির কার্যকারিতা ধীরে ধীরে শেষ হবে। অবশ্য আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ কোষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এ-জাতীয় কোনো সংক্রামকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।’
আমাদের এখন এটি মনে করতে হবে, আমরা টিকা নিচ্ছি কভিড-১৯ মোকাবিলায় নয়, এ-জাতীয় সংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলায়। রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এটিই ভালো পদক্ষেপ। আমাদের প্রতি বছর এ টিকা নিতে হবে। কারণ বছর ঘুরলেই ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ধরন পরিবর্তিত হয়। কেফোটের মতে, ১০ বছর ধরে ট্রায়াল বা পর্যবেক্ষণ করার মতো সময় আমাদের কাছে নেই। তাই প্রাথমিক ট্রায়ালের ভালো ফল পাওয়া গেলেই অনুমোদন দেয়া উচিত বাজারজাতকরণের।
আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্যমতে, ফাইজার ও বায়োএনটেকের টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। অক্সফোর্ড অস্ট্রাজেনেকা টিকার কার্যকারিতার বিষয়ে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী এন্ডিউ পোলার্ড আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবিসি নিউজকে বলেন, ‘টিকার প্রভাব নিয়ে এখনই বলার মতো কিছুই হয়নি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও সেরকম কিছুই অনুমান করা যায়নি। মানুষের ওপর প্রয়োগ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
এ টিকার বিষয়ে একটি ব্রিটিশ গবেষক দল এবিসি নিউজকে জানিয়েছেন, ‘একটি ডোজ দেয়ার পরে অক্সফোর্ডের টিকার কার্যকারিতা ৭০ শতাংশ হবে। পরবর্তী চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ দিলে কার্যকারিতা ৮০ শতাংশে পৌঁছাবে ১২ সপ্তাহ পরে।
কভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের পথে অনেকদূর এগিয়েছে বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোব-বায়োটেক। ইতোমধ্যে প্রাথমিক সফলতা দেখতে পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। টিকার কার্যকারিতা যাচাইয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে প্রক্রিয়াও শুরু করেছে।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ড. মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘যে কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা বাজারজাত করার আগে মানবদেহে প্রয়োগ করে কয়েক বছর পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যাচাই করে দেখা হয়। এরপরই টিকা বাজারে ছাড়া হয়। এটিই নিয়ম। কিন্তু করোনাভাইরাসের টিকার ক্ষেত্রে সেটি মানা হচ্ছে না। জরুরি টিকা হিসেবেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সফলতা দেখেই তা বাজারে ছাড়ার অনুমতি পাচ্ছে।’
এ টিকার কার্যকারিতা কতদিন থাকবে বলে মনে করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটি এখনও সুনির্দিষ্ট করে বলার মতো হয়নি। এটি বলাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ টিকা প্রয়োগের পর তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। চিকিৎসা পদ্ধতিতে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ওপর পর্যবেক্ষণ করা হয় টিকা গ্রহণকারীদের। এটি সম্ভব না হওয়ায় বলা যাচ্ছে না। কিন্তু অক্সফোর্ডের টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেই কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তারপরও শেষ পর্যন্ত অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখন বলছে, অন্তত দুটি ডোজ নিতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফাইজার ও মডার্নার টিকার ধরন একই হবে। অরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সায়েন্সের পরিচালক চুনহুয়েই চি বলেন, ইমিউনিটি বৃদ্ধির বেলায় টিকার কার্যকারিতার মেয়াদ খুব বেশি নয়। প্রতি বছরই টিকা নিতে হবে আমাদের। অন্যদিকে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপকের মতে, এসব টিকার কার্যকারিতা দুই থেকে তিন বছর হতে পারে। সময়টি বাড়তে বা কমতেও পারে।