তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা পাচার করেছেন পিকে হালদার। এ কাজে তিনি তার মা লীলাবতী হালদারকেও ব্যবহার করেছেন। লীলাবতীর নামে তিনটি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকে ১৬০ কোটি টাকা স্থানান্তরের নজির পাওয়া গেছে।
একপর্যায়ে এখান থেকে প্রায় পুরো টাকাই তুলে নেয়া হয়। কিন্তু লীবতীর হিসাব থেকে তুলে নেয়া টাকা কোথায় গেছে সে তথ্য মিলছে না। যে কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে কিছু অর্থ নগদ আকারে তুলে নিয়ে এবং কিছু বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও বিশদ তদন্ত হচ্ছে।
পিকে হালদারের আর্থিক খাতে জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) করা একাধিক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও বিশদ তদন্ত হচ্ছে।
দেশের ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের নায়ক পিকে হালদার। এ কেলেঙ্কারিতে তিনি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় নিজের মা লীলাবতী হালদারকেও ব্যবহার করেছেন। তার মা’র হিসাব থেকে ১৫৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা তুলে নেয়ার পর বাকি সামান্য কিছু অর্থ এখনও হিসাবে পড়ে আছে। হিসাবটি জব্দ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে নেয়া অর্থ নানা প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে পিকে হালদারের মা লীলাবতীর বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে। লীলাবতী পিরোজপুর জেলার একটি স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা। তিনি সর্বসাকুল্যে বেতন পেতেন ৪৫ হাজার টাকা। সংসার খরচ মিটিয়ে এত টাকা তার ব্যক্তিগত হিসাবে জমা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি কোনো সম্পদও বিক্রি করেননি যে এত টাকা তার হিসাবে জমা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পিকে হালদার যেসব ভুয়া ও বেনামি কোম্পানি খুলে আর্থিক খাতে জালিয়াতি করেছেন তার বেশ কয়েকটির সঙ্গে লীলাবতীর নাম জড়িত রয়েছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে যেসব অর্থ নেয়া হয়েছে তা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লীলাবতীর হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের হিসাবে এত টাকা জমা হওয়া এর লেনদেনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কখনোই কোনো প্রশ্ন তোলেনি। অথচ ব্যাংকের উচিত ছিল এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা। তার ব্যাংক হিসাব খোলার ফরমে লেনদেনের উল্লিখিত সীমার চেয়ে প্রকৃতি লেনদেন কত বেশি হচ্ছে এবং কেন। অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী গ্রাহকের কাছে এর ব্যাখ্যা চাওয়া ব্যাংকের অবশ্য করণীয় ছিল। সন্দেহজনক হলে বিএফআইইউকে জানানো জরুরি ছিল। কিন্তু কোনো ব্যাংক এসব কিছুই করেনি। উল্টো গ্রাহককে নানাভাবে সহায়তা করেছে।
সূত্র জানায়, পিকে হালদার ও তার সহযোগীরা লীলাবতীর নাম ব্যবহার করেছেন। ব্যাংক কর্মকর্তারাও তাকে চিনতেন না। জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর লীলাবতীর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচার আইন অনুযায়ী গ্রাহকের লেনদেনের বার্ষিক সীমা উল্লেখ করতে হয়। এর বেশি লেনদেন হলে গ্রাহকের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে হয়। গ্রাহক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে না পারলে বিএফআইইউকে জানাতে হয়। তখন বিএফআইইউ এগুলো তদন্ত করে।
পিকে হালদার যখন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তখন ইমেক্সকো ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স বর্ণা ও ওরিয়াল এন্টারপ্রাইজ- এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৬৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। ঋণের পুরো টাকাই লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয়।
জালিয়াতির টাকা সরাতে পিকে হালদার সুখাদা লিমিটেড নামে একটি ভুয়া কোম্পানি খোলেন। এতে পিকে হালদারের শেয়ার ৯০ শতাংশ ও তার মা লীলাবতী হালদারের ৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এ হিসাবে প্রথমে ২০ কোটি ৪১ লাখ টাকা জমা হয়। পরে এ অর্থ লীলাবতীর হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
ব্যাংক এশিয়ার ধানমণ্ডি শাখায় পিকে হালদারের দুটি হিসাবে বিভিন্ন সময়ে ২৪৪ কোটি টাকা জমা হয়। এ হিসাব থেকে রিলায়েন্স ব্রোকারেজ হাউজের হিসাবে ২০৫ কোটি টাকা এবং লীলাবতী হালদারের হিসাবে স্থানান্তর করা হয় ৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
নামে-বেনামে শেয়ার কিনে ২০১৫ সালে পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় আনান কেমিক্যাল। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ও রিলায়েন্স ব্রোকারেজের মাধ্যমে এ শেয়ার কেনা হয়। এসব লেনদেনের টাকাও লীলাবতীর হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এর মধ্যে শরিয়াভিত্তিতে পরিচালিত একটি বেসরকারি ব্যাংকে লীলাবতীর হিসাব খোলা হয় ২০১৩ সালের ৭ মার্চ।
কিছু লেনদেন করে ওই বছরের ২৬ আগস্ট হিসাবটি বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রায় ৬ মাসে ওই হিসাবে ১৯ কোটি টাকা জমা করে ইমেক্সকো ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স বর্ণা ও ওরিয়াল এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। একই ব্যাংকের আরেকটি হিসাবে এসব প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকে জমা করা হয় ৯ কোটি টাকা। টাকা উত্তোলন করে হিসাব খোলার ৩০ দিনের মধ্যে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া জালিয়াতির টাকা সরাতে পিকে হালদার আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, রেপটাইল ফার্মাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠা করেন। কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদারসহ অন্যরা।