মহামারি করোনার বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যেই অতিবাহিত হয়েছে ২০২০ সাল। অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো বীমাখাতেও ছিল নানা শঙ্কা, নানা প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু এসব শঙ্কা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বীমাখাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ছিল সরকারের নানা উদ্যোগ। এসব উদ্যোগের সুফল বীমাখাতে ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। যা নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে বলে খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদায়ী বছরে বীমাখাতে ব্যর্থতার চেয়ে সফলতার পাল্লাই বেশি ছিল। খাতটির উন্নয়নে ও খাতটির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়াতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তপক্ষ (আইডিআরএ) বছরজুড়ে ছিল বেশ তৎপতর। প্রতিষ্ঠানটির নানা উদ্যোগের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বীমা কোম্পানিগুলো এবং খাতটির নেতৃত্বে থাকা সংগঠন বাংলাদেশ্ ইন্সুরেন্স এসোসিয়েশন’। যে কারণে করোনার মধ্যেও উন্নয়নের পথে এগিয়েছে দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম অংশীদার বীমাখাত।
২০২০ সালে বীমাখাতে উল্লেখযোগ্য ১৪ ঘটনা নিচে উল্লেখ করা হলো।
১. জাতীয় বীমা দিবস চালু: বিদায়ী ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো দেশে জাতীয় বীমা দিবস উদযাপন করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বীমা পেশায় যোগদানের দিনকে জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণা করে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদায়ী বছরের ১ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দিবসটি উদযাপনের আয়োজন করে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং আইডিআরএ। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দিবসটির উদ্বোধন এবং খাতটির সার্বিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনা খাতটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রত্যয়ী ও আশাবাদী করে তুলেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালের ১ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে যোগদান করেন। দিনটিকে স্মরণে রাখতে গত ১৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রীপরিষদ সভায় সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে অনুযায়ী রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মহাসমারোহে দিবসটি পালিত হয়।
২. কমিশন নির্ধারণ: বীমাখাতে কমিশন বাণিজ্য বন্ধে আইডিআরএ’র উদ্যোগ ছিল বড় আলোচিত। এর আগে বীমাখাতে কমিশনের নির্ধারিত কোন হার ছিল না। ফলে কোম্পানিগুলোর আয়ের বড় অংশই কমিশন পরিশোধে চলে যেতো। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গেল বছর আইডিআরএ এজেন্টদের কমিশন সর্বাচ্চ ১৫ শতাংশ বেঁধে দেয়। যদিও উদ্যোগটি কার্যকর করতে প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বীমাখাতে কমিশন বেঁধে দেয়ায় এখাতে যেমন বড় একটি অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ হয়েছে, অন্যদিকে বীমা কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধিরও বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।
৩. উন্নয়ন কর্মকর্তাদের এজেন্টে রূপান্তর: নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোতে ব্যবসা আহরণের নিমিত্ত সকল উন্নয়ন কর্মকর্তাকে ১ মার্চ ২০২০ তারিখ থেকে কমিশনের ভিত্তিতে বীমা এজেন্ট হিসেবে পদায়ন করতে হবে- এমন নির্দেশনা দিয়ে ২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আইডিআরএ। প্রজ্ঞাপনটি জারির পর কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হয়। পরবর্তীতে বিআইএ এবং বিআইএফ’র সাথে আলোচনায় প্রজ্ঞাপনটি বাস্তবায়নের সময়সীমা বাড়ানো হয়। এই উদ্যোগছি ছিল বছরের অন্যতম আলোচিত।
৪. ব্যাংকাস্যুরেন্স চালু: স্বচ্চতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় ব্যাংকাস্যুরেন্স’ নামের নতুন ধারণা বীমাখাতে ছিল আলোড়িত উদ্যোগ। বীমাখাতে স্বচ্চতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যাংকাস্যুরেন্স নীতি বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে। ব্যাংকাস্যুরেন্স নীতি হলো-দেশের ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে বিমা পলিসি বিক্রি হবে। গ্রাহকদের আর বিমা কোম্পানিতে যেতে হবে না, ব্যাংকের শাখায় গেলেই চলবে। অর্থাৎ ব্যাংক তার নিজের গ্রাহকের কাছে নিজেদের পণ্য তো বিক্রি করবেই, বিমা পণ্যও বিক্রি করবে। বিমা নিয়ে মানুষের নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে সরকার এমন উদ্যোগ নিয়েছে। আডিআরএ ব্যাংকাস্যুরেন্স’ সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা ইতোমধ্যে জারিও করেছে। নীতিমালাটির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকও একমত হয়েছে। বর্তমানে নীতিমালাটি চুড়ান্ত করার পর্যায়ে রয়েছে। নীতিমালাটি বাস্তবায়ন শুরু হলে বিমাখাতে নতুন অধ্যায় সূচিত হবে বলে মনে করছেন এই খাতসংশ্লিষ্টরা।
৫. থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল: সরকার কর্তৃক মোটরযানে তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তথা থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল করার পর আইডিআরএ গত ২০ ডিসেম্বর মোটরযানে থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্পটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করে। মোটরযানে থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল বিষয়টি ছিল বীমাখাতে বেশ আলোচিত ঘটনা।
৬. কম্প্রিহেনসিভ বীমা পরিকল্প চালু: থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল করার পর মোটরযানে আরও শক্তিশালী বীমা পরিকল্প চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে আইডআরএ। পরিকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে কম্প্রিহেনসিভ বীমা পরিকল্প’। পরিকল্পটি চালু করার জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর ১৩ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিয়েছে আইডিআরএ।
৭. নতুন ৩ বীমা পরিকল্প চালু: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে দু’টিসহ নতুন ৩ বীমা পরিকল্প চালু করার অনুমোদন দিয়েছে বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। গত ১১ অক্টোবর আইডিআরএ’র ১২৮তম সভায় এসব বীমা পরিকল্প ও এর শর্তাবলী এবং প্রিমিয়াম হার অনুমোদন দেয়া হয়। পরিকল্প ৩টি হলো- বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা, বঙ্গবন্ধু স্পোর্টসম্যান’স কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্স এবং স্পোর্টস ইন্স্যুরেন্স। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা’র প্রস্তাবক সাধারণ বীমা করপোরেশন, বঙ্গবন্ধু স্পোর্টসম্যান’স কম্প্রিহেনসিভ ইন্স্যুরেন্স’র প্রস্তাবক বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স এবং স্পোর্টস ইন্স্যুরেন্স’র প্রস্তাবক গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স।
৮. মৃত্যুদাবি পরিশোধে নতুন উদ্যোগ: বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লাইফ বীমা কোম্পানির গ্রাহকদের মৃত্যুদাবির চেক হস্তান্তর শুরু করেছে আইডিআরএ । গত ২৫ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু আশার আলো-বীমা দাবি নিষ্পত্তির প্রয়াস’ নামে এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানটি ফেসবুক লাইভে সম্প্রচার করা হয়।
৯. লাইফ বীমা ব্যবস্থাপনায় ব্যয়সীমা নির্ধারণ: লাইফ বীমা পুরনো কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয়ের সীমা বাড়িয়ে এবং নতুন কোম্পানিগুলোর জন্য কমিয়ে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। গত ৯ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এই গেজেট প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও বিদায়ী বছরে লাইফ ইন্স্যুরেন্স গ্রাহক নিরাপত্তা তহবিল প্রবিধানমালা, ২০১৬ সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
১০. তালিকাভুক্তিতে বিশেষ ছাড়: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য ৩০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের বাধ্যবাদকতা ছিল। অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত কমিশন পুঁজিবাজারে আসার পথ সহজ করার জন্য বীমা কোম্পানিগুলোকে শর্তটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। তবে বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের ইক্যুইটির কমপক্ষে ২০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে হবে। যা বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য পরিপালন করা খুবই সহজতর। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ উদ্যোগের ফলে বীমা কোম্পানিগুলো একের পর এক পুঁজিবাজারে আসতে শুরু করেছে।
১১. ছয়বীমা কোম্পানির১২ পরিচালক অপসারণ: দুই শতাংশের কম শেয়ার ধারন করায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৬ বীমা কোম্পানির ১২ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের কমিশন ৬ বীমার ১২ পরিচালককে অপসারণ করে পুঁজিবাজারে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
১২. সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ডের অঙ্গীকার: আইডিআরএ’র বর্তমান চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের সময়ে বলেছেন, বীমা কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্ড দিতে হবে। এই লক্ষ্য পুরণের প্রত্যয় নিয়ে কোম্পানিগুলোকে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। কোম্পানিগুলো যাতে বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ড দিতে পারে, সেজন্য আইডিআরএ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতারও আশ্বাষ দিয়েছেন তিনি। এদিকে কোম্পানিগুলোর পারফরমেন্স দেখেও মনে হচ্ছে, আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোম্পানিগুলোর জন্য অসম্ভব হবে না। কারণ গত অর্থবছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর’২০) তালিকাভুক্ত ৪৯টি লাইফ ও নন-লাইফ ইন্সুরেন্সের মধ্যে করোনার মধ্যেও সিংহভাগ কোম্পানির মুনাফা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় রয়েছে।
১৩. ডিভিডেন্ড দেয়ার বাধ্যবাদকতা: পুঁজিবারে তালিকাভুক্ত বীমাখাতে কোম্পানির সংখ্যা বর্তমানে ৪৯টি। এর মধ্যে নন-লাইফ ৩৭টি এবং লাইফ ১২টি। কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৩১ ডিসেম্বর. ২০১৯ সালের অর্থবছরের জন্য ১টি নন-লাইফ ও ২টি লাইফ বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি। বাকি ৪৪টি কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দিয়েছে। ডিভিডেন্ড দেয়ার হার ছিল প্রায় ৯৭ শতাংশ। এটি ছিল গত ১০ বছরের মর্ধে সর্বোচ্চ। গত ১০ বছর বীমাখাতে ডিভিডেন্ড দেয়ার শতকরা হার ৮৭ শতাশের নিচে ছিল। এদিকে, গত বছর পুঁজিবাজারে আসা এক্সপ্রেস ইন্সুরেন্স প্রথম বছরেই নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি তাৎক্ষনিকভাবে বিষটিতে হস্তক্ষেপ করে এবং কোম্পানিটিকে অন্তবর্তী ডিভিডেন্ড দিতে বাধ্য করে। পুঁজিবাজারে এটি ছিল অন্যতম আলোচিত ঘটনা।
১৪. সরকারি কোষাগারে সর্বোচ্চ রাজস্ব: ২০২০ সালে লাইফ ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো সরকারি কোষাগারে দুই হাজার কোটির টাকারও বেশি রাজস্ব জমা দিয়েছে। যা হবে সরকারি কোষাগারে বীমা কোম্পানিগুলোর এ যাবত কালের মধ্যে সর্বোচ্চ রাজস্ব। বীমা কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়াতেই সরকারি কোষাগারে কোম্পানিগুলোর রাজস্ব জমার পরিমাণও বেড়ে গেছে।