দেশের মুদ্রিত পণ্যের ইন্ডাস্ট্রির বিকাশে ভূমিকা রাখা কোম্পানিটি কীভাবে লোকসানের মুখে পড়ল।
২০০১ সালের এক শীতের সকালে মারুফ হোসেন নামে এক উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া তরুণ প্রেম নিবেদন করেছিলেন তারই এক সহপাঠীকে। মেয়েটির নাম শায়লা ইসলাম। সেই সময় বলিউডে সাড়া জাগানো জুটি শাহরুখ-কাজল ছিল বাংলাদেশেও তুমুল জনপ্রিয়।
মারুফ তার প্রিয়তমাকে নিজের ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে দিয়েছিলেন শাহরুখ খানের ছবিসহ তিনটি ভিউকার্ড ও একটি ডায়েরি। বিনিময়ে শায়লাও মারুফকে দিতে ভুল করেননি কাজলের পিন-আপ ছবিসহ একটি নোটবুক।
এমনটাই ছিল সেই পুরনো দিনগুলোর প্রেম। আর সেই প্রেমের দিনগুলোর সাক্ষী হয়ে ছিল আজাদ গ্রুপের পণ্য।
আজ ৩৮ বছর বয়সী মারুফ যখন পেছনে ফিরে তাকান, তিনি মনে করতে পারেন, ‘তখন খুলনা নিউমার্কেটে আজাদ গ্রুপের পণ্যের একটা সুন্দর শো-রুম ছিল আর আমি ছিলাম তার নিয়মিত ক্রেতা। সেসব দিনগুলোতে ঈদ বা পূজায় কখনোই শায়লাকে কার্ড পাঠানো মিস হতো না আমার।’
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার প্রযুক্তি আসার আগে ডায়েরি, পিন-আপ, পোস্টার, ভিউকার্ড ইত্যাদির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল তরুণ প্রজন্মের কাছে। আজাদ প্রাইভেট লিমিটেড তখনকার একটি অতি পরিচিত নাম এবং অল্পদিনেই তারা এই ব্যবসায়ে বেশ এগিয়ে যায়। কিন্তু বিগত দুই দশক ধরে আধুনিক প্রযুক্তির উত্থানের ফলে আজাদ গ্রুপ তথা পুরো প্রিন্টিং শিল্পই প্রায় তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এর কারণ, আজকাল স্মার্টফোন, ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে এক মুহূর্তেই প্রিয়জনকে ম্যাসেজ পাঠানো যাচ্ছে, তরুণ সমাজ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে বেছে নিচ্ছে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি মাধ্যমকে। সে কারণেই এই শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
আজাদ প্রোডাক্টসের শুরু ও প্রসার যেভাবে
আজাদ কোম্পানির কর্ণধার আব্দুল কালাম আজাদের জন্ম চাঁদপুরে এবং বেড়ে ওঠা শরীয়তপুরে। ব্যবসায়ী হবার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৩ সালে ঢাকায় পা রাখেন তিনি। শুরুতে ছিলেন গৃহশিক্ষক। সেই সময় ঢাকার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতেন আর দেখতেন কীভাবে মানুষ স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা করে।
সেসময় বাংলাদেশ টেলিভিশন সবেমাত্র বিদেশি অনুষ্ঠান প্রচার করা শুরু করেছে। ডালাস, বায়োনিক ওম্যান, ডাইন্যাস্টি ইত্যাদি সিরিজের চরিত্রগুলো মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বলে জানান আজাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান।
আজাদ বলেন, তিনি কিংবদন্তী ফুটবলার ম্যারাডোনা, গানের দল বনি এম ও সুইডিশ পপ গ্রুপ এবিবিএ-এর পিন-আপ আমদানি করতেন। তিন মাসের মধ্যেই আজাদের পুঁজি দাঁড়িয়েছিল ৭০ হাজার টাকায়।
আজাদ সেসময় বিভিন্ন জনপ্রিয় তারকাদের পোস্টার আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করেছিলেন দেশে। আশির দশকে পীযূষ বন্দোপাধ্যায় ও আফরোজা বানু অভিনীত ‘সকাল-সন্ধ্যা’ নামক বাংলা নাটকও বেশ জনপ্রিয় হয়। সেখান থেকে আজাদের মাথায় আইডিয়া আসে, দেশীয় তারকাদের নিয়ে পোস্টার ও কার্ড বানালে কেমন হয়!
কিন্তু একজন ফেরিওয়ালার পক্ষে তারকাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা মোটেও সহজ ছিল না। তাই একদিন তিনি যখন দেখলেন, ‘তারকালোক’ ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে পীযূষ-আফরোজার ছবি, তিনি সেখান থেকেই বানালেন পোস্টার। সেই টিভি নাটকটি এতই জনপ্রিয় ছিল, প্রচুর মানুষ সেসব পোস্টার ও পিন-আপ কেনে এবং সেইসঙ্গে আজাদের ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে।
আজাদের ভাষ্যে, ‘সে সময় আমার ব্যবসায়ে মুনাফা এত বেশি ছিল যে, আমরা চাইলে ২০ তলা ভবন করতে পারতাম।’
কিন্তু আজাদ গ্রুপের সেই সোনালি দিন আজ আর নেই। বছরের পর বছর ধরে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে কোনোমতে টিকে আছেন তারা।
আজাদ বলেন, আগে পহেলা বৈশাখে তার কোম্পানি বাংলা ক্যালেন্ডার বিক্রি করত ২০-২৫ লাখ টাকার, যা এখন ৩-৪ লাখে নেমে এসেছে। আগে ডায়েরির অর্ডার পেতেন তারা ৫০ থেকে ৬০ হাজার পিস, কিন্তু এ বছর ডায়েরির অর্ডার পেয়েছেন মাত্র ১০ হাজার। গতবছর দুই কোটি টাকার ব্যবসা হলেও এ বছরটা ৫০ লাখ ছাড়াবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তার।
করোনাভাইরাসের কারণে আজাদ গ্রুপের দশটি শোরুমের পাঁচটিই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন তাদের ব্যবসা চলছে মূলত করপোরেট ক্রেতা ও বিয়ের কার্ডের চাহিদার ওপর।
গত ৪০ বছর ধরে যে মানুষ নানা ঝড়ঝাপ্টা পার করে এসেছেন, তিনি বর্তমানে নিজের কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আজাদ প্রোডাক্টস একটি বিলুপ্তপ্রায় বিষয়।
‘কিন্তু একসময় আমি রাজা ছিলাম!’ বলে নিজের উত্থান-পতনের গল্প শেষ করলেন আবুল কালাম আজাদ।
সুত্রঃ বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড