দেশের পুঁজিবাজারের সদস্যভুক্ত শীর্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাসান ইমামের বিরুদ্ধে ৭০০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। গত পাঁচ বছরে রেস পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবহার করে তার নিজস্ব কোম্পানি, সংস্থা, তহবিলের সুবিধার্থে আইন বর্হিভূত এসব লেনদেন করেছেন। এতে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।
বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ থেকে করা এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, পুঁজিবাজার থেকে যোগসাজশের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ রেস ম্যানেজমেন্টের সিইও এবং এমডি হাসান ইমাম। তিনি নিজেই এ চক্রের নেতৃত্ব দিতেন। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন তারই প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানির শীর্ষ পদে থাকে তিন ব্যক্তি। ওই তিন ব্যক্তিই আবার রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ট্রাস্ট্রি প্রতিষ্ঠান বিজিআইসির মনোনীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ রয়েছে, রেস পরিচালিত মিউচুয়াল ফান্ডের ট্রাস্ট্রি বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির (বিজিআইসি) বোর্ডে সদস্য হিসেবে ছিলেন হাসান ইমামের বড় বোন (পিমা ইমাম) এবং তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু কায়সার ও মুনজুর। মোহাম্মদ মুনজুর মাহমুদ ডাটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেড ঢাকার প্রেসিডেন্ট ও কায়সার ইসলাম ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট স্টেপস লিমিটেড ঢাকার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানা যায়, ডাটাসফট সিস্টেমস ও ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট স্টেপসের মালিকানায় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রয়েছেন হাসান ইমাম। অর্থাৎ বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ট্রাস্ট্রি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জেনারেল ইনস্যুরেন্সকেও হাসান ইমাম সুপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। যা বিএসইসির মিউচুয়াল ফান্ডের বিধিমালা ও আইন বহির্ভূত কাজ।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (মিউচ্যুয়াল ফান্ড) বিধিমালা অনুযায়ী, ২০০১ এর বিধি ১৯(১)(ঘ) উল্লেখ রয়েছে-‘নিবন্ধন মঞ্জুরীর জন্য অযোগ্যতা- কোন কোম্পানি, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ট্রাস্টি হিসাবে নিবন্ধন মঞ্জুরীর জন্য যোগ্য হইবে না যদি- উহা বা উহার কোন পরিচালক কোন মিউচুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তা বা সম্পদ ব্যবস্থাপক, স্টক ডিলার, স্টক ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার হন বা উহার বা উহাদের অধীন কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কোন পরিচালক হন বা উহার সহিত কোন ভাবে সম্পর্কিত হন।’
অভিযোগ রয়েছে, মাল্টি সিকিউরিটিজে অতিরিক্ত তহবিল সংরক্ষণ এবং বাজার কারসাজি করার জন্য তৃতীয় পক্ষকে অর্থ ঋণস্বরূপ প্রদান করতেন হাসান ইমাম। যাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী। এছাড়া ব্রোকারেজ হাউজকে ১৮-২৫ পয়সা এর পরিবর্তে ৪৫-৫০ পয়সা কমিশন প্রদান এবং অতিরিক্ত কমিশন ব্যক্তিগতভাবে নগদ ফেরত নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছে তদন্তকারী সিআইডি কর্মকর্তা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান ইমাম গত ৫ বছরে রেস ফান্ড ট্রেড অপারেশনে প্রায় ৭০০ কোটি মূল্যের অনৈতিক ও আইনবিরুদ্ধ লেনদেন করেছেন। যাতে পাবলিক ফান্ডগুলো এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া তিনি মাল্টি সিকিউরিটিজ নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং এর সুবিধা গ্রহণ করছেন। তার পরিচালিত রেস অ্যাসেটের মাধ্যমে অল্প সময়ে প্রচুর অর্থ জালিয়াতি করেছেন।
বিজআইসিতে হাসান ইমামের ইচ্ছাকৃত এবং অসৎ উদ্দেশ্যে তার বড় বোন, স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে সিআইডি। সংস্থাটি জানায়, ব্যক্তিগত লাভের জন্য স্বার্থের সংঘাতের সুযোগ নিয়ে হাসান ইমাম ব্যক্তি স্বার্থ নিশ্চিত করেছেন। যা অনৈতিক কর্মের চূড়ান্ত শিকার।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মিউচুয়াল ফান্ড খাত বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। সুশাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি থাকায় খাতটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। সম্প্রতি এক সম্পদ ব্যবস্থাপক অর্থ আত্মসাৎ করে দুবাইয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আবারো সামনে এসেছে এ খাতের দুর্দশার চিত্র।
মিউচুয়াল ফান্ড খাতের এ দুর্দশা নিয়ে গতকাল (২৫ আগস্ট) কমিশন ভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসির কমিশনার ড. এটিএম তারিকুজ্জামান বলেন, পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডে কিছু কিছু অনিয়ম হয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড সংক্রান্ত আইন বা বিধি-বিধানের ক্ষেত্রের বৈষম্যতা ছিল। আগামীতে সেই বৈষম্য আমরা দূর করার চেষ্টা করব। সেই বৈষম্যমূলক আইন ও বিধি-বিধানগুলো রিভিউ করা হবে। মিউচুয়াল ফান্ডে যেসব বৈষমতা হয়েছে আমরা তা চিহ্নিত করে সমাধান করব।
তিনি বলেন, সবার জন্য আইন সমান। এটা বাস্তবায়নে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখন থেকে শেয়ারবাজারে আর দুর্নীতি চলবে না। অনিয়ম আর চলবে না।
এদিকে গত ১৩ জুন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস ও তার অধীনে পরিচালিত ফান্ডগুলোর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। বিএফআইইউর নির্দেশনায় বলা হয়, আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক জানানো যাচ্ছে, আপনাদের প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এবং এর অধীনে পরিচালিত ফান্ডসমূহের সব ব্যাংক হিসাব, এফডিআর ও এমটিডিআর হিসাবসমূহের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২৩(১)(গ) ধারার আওতায় আগামী ৩০ দিনের জন্য অর্থাৎ ১০ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হলো।
বাংলাদেশ রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের পরিচালিত ফান্ডগুলো হলো- এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইবিএল ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ইবিএল এনআরবি মিউচুয়াল ফান্ড, এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট বাংলাদেশ মিউচুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, রেস স্পেশাল অপরচুনিটিস ইউনিট ফান্ড, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড এবং রেস ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুসন ইউনিট ফান্ড।