ঋণখেলাপি, উৎপাদন বন্ধ ও জেড শ্রেণিভুক্ত এমন কোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবে না রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। পাশাপাশি সংস্থাটি একক কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নতুন নিয়ম মেনে চলবে। তা হল, ওই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারে বিনিয়োগ করবে না। আবার কোনো মিউচুয়াল ফান্ডের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করবে না রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। সম্প্রতি আইসিবি নতুন যে বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরি করেছে, তাতে এসব কঠোর নিয়ম সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে।
গত ৩০ জুন সংস্থাটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ নীতিমালা–২০২৪’ শীর্ষক নতুন নীতিমালাটি অনুমোদন করা হয়। আইসিবি বলছে, নতুন এই নীতিমালা ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়েছে। বিনিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট কমিটি নামে আট সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে সংস্থাটির একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি)।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে শেয়ারবাজারে আইসিবির ভূমিকা ও বিনিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। অতীতে ব্যক্তিস্বার্থ ও কারসাজিকারীদের সঙ্গে মিলে সংস্থাটি এমন কিছু বিনিয়োগ করেছে, যে কারণে মূলধন সংকটে পড়তে হয়েছে। সংস্থাটির বিপুল বিনিয়োগ বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে আটকে গেছে। বাজে কোম্পানিতে ও চড়া দামে শেয়ার কিনে আইসিবিকে অতীতে বিপুল লোকসান গুনতে হয়েছে। এ অবস্থায় সংস্থাটির বিনিয়োগে স্বচ্ছতা আনতে এবং এটির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগের নতুন নীতিমালা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক শাকিল রিজভী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি, আইসিবির বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো স্বচ্ছতা ছিল না। সংস্থাটির বিনিয়োগের বড় অংশই ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। কখনো কখনো ব্যক্তিবিশেষকে সুবিধা দিতে চড়া দামে শেয়ার কিনে লোকসান দিয়েছে সংস্থাটি। এসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন যদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে তা পুঁজিবাজারের জন্য ভালো। নীতিমালায় ভালো অনেক কথাই থাকে; কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর প্রয়োগ না হলে নীতিমালা করে কোনো লাভ নেই। তাই আমরা আশা করি, বাজারের স্বার্থে আইসিবি তাদের এই নীতিমালা যথাযথভাবে পালন করবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, আইসিবি পুঁজিবাজারে ভাগে বিনিয়োগ করবে। তা হলো স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। এক বছরের কম সময়ের জন্য করা বিনিয়োগ বিবেচিত হবে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে। মধ্যমেয়াদি বিনিয়োগ হবে এক থেকে তিন বছরের। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা হবে তিন বছরের বেশি সময়ের জন্য। তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারের পাশাপাশি ট্রেজারি বিল, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড ও রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট ফান্ডে বিনিয়োগ করবে সংস্থাটি।
তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জেড শ্রেণিভুক্ত তথা খারাপ শেয়ারে নতুন কোনো বিনিয়োগ না করার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়। তবে আগে কেনা কোনো কোম্পানি যদি জেড শ্রেণিতে স্থানান্তরিত হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে ওই কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হবে। আর বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কৌশল হিসেবে গড় ক্রয়মূল্য কমিয়ে আনতে নতুনভাবে ওই কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা যাবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এর বাইরে ঋণখেলাপি কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইসিবির পরিচালনা পর্ষদ। এ বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হলে বা কোম্পানির সিআইবি প্রতিবেদনে কোনো সমস্যা থাকলে এবং ঋণ অনাদায়ে কোনো কোম্পানি বিচারের মুখোমুখি হলে সেই কোম্পানিতে কোনো বিনিয়োগ করবে না আইসিবি।
ঋণখেলাপির পাশাপাশি বন্ধ কোম্পানিতেও কোনো বিনিয়োগ করবে না রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিনিয়োগ সংস্থা। নতুন বিনিয়োগ নীতিমালায় এ বিষয়ে বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না বা কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান আছে কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই, সেসব কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবে না আইসিবি।
মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, এ ধরনের ফান্ড বা তহবিলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তহবিলের মূল উদ্যোক্তার বিনিয়োগের সমপরিমাণ বা তার কম বিনিয়োগ করা হবে। এ ছাড়া আইসিবি কোনো ফান্ডের ট্রাস্টি বা হেফাজতকারী হিসেবে যুক্ত থাকলে ওই ফান্ডে আইসিবি বা তাদের কোনো ফান্ড থেকে বিনিয়োগ করা হবে না।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, সাধারণভাবে লোকসানি কোনো শেয়ার বিক্রি করবে না আইসিবি। তবে কিছু ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে লোকসানি শেয়ার বিক্রির কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে, কোনো কোম্পানি তালিকাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে এবং মৌলভিত্তির দুর্বলতার কারণে শেয়ারের বাজারমূল্য আর ক্রয়মূল্যের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা না থাকলে সে ক্ষেত্রে লোকসানে ওই শেয়ার বিক্রি করতে পারবে আইসিবি। এ ছাড়া দুই বছরের বেশি সময় ধরে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম নিম্নমুখী থাকলে ওই কোম্পানির শেয়ারও লোকসানে বিক্রি করা যাবে এবং সব ধরনের আইপিওতে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে নীতিমালায়।
শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন নীতিমালায় ভালো অনেক সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন কতটা হয় সেটিই বড় প্রশ্ন। নীতিমালাটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে তাতে আইসিবির সক্ষমতা অনেক বাড়বে।