বিশ্বব্যাপী স্টক এক্সচেঞ্জকে শেয়ারবাজারের প্রাথমিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলা হয়। বাংলাদেশের আইনেও অনিয়ম প্রতিরোধ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে তা স্রেফ কাগজে। বাস্তবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না স্টক এক্সচেঞ্জ। খোদ শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একের পর এক ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে। এমন অভিযোগ স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও বাজার ব্যবহারকারী অনেকেরই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সবাই দোষারোপ করলেও শেয়ার কারসাজি হচ্ছে দেখেও স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থা নিতে পারে না। কেবল অনলাইন সার্ভেল্যান্সের তথ্য বিএসইসিতে পাঠাতে পারে। আইন অনুযায়ী তালিকাভুক্তির ক্ষমতা স্টক এক্সচেঞ্জের। তবে আইপিওতে আসা কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত না করে উপায় থাকে না। তালিকাভুক্তির পর কোম্পানি অনিয়ম করলে, আইন অনুযায়ী বিনিয়োগকারীদের তথ্য না দিলে লেনদেন স্থগিত করে দেওয়া বা তালিকাচ্যুত করা ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু এ ক্ষমতাও ব্যবহার করতে পারে না। কোনো কোম্পানির অফিস বা কার্যালয় পরিদর্শনে যেতেও অনুমতি নিতে হয়। আবার অনুমতি চেয়েও মাসের পর মাস এমনকি বছরও অপেক্ষায় থাকার নজির আছে।
কোনো শেয়ারের ক্যাটেগরি নির্ধারণ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন আছে। সে ক্ষেত্রেও নির্দেশনা নিয়ে পূর্বানুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বিএসইসি। সমালোচনার মুখে এজিএম না করা কোম্পানিকে ‘জেড’ ক্যাটেগরিভুক্ত করতে অনুমতি দিলেও বছরের পর বছর লভ্যাংশ না দেওয়া কোম্পানির ক্ষেত্রে তা কার্যকর করতে দেয়নি।
কর্মকর্তারা জানান, স্টক এক্সচেঞ্জে কখন লেনদেন হবে, তা বিশ্বের কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক করে দেয় না। গত ৭ মার্চ ধর্মীয় দিক ও রোজাদারদের সুবিধার্থে লেনদেন সময় এক ঘণ্টা কমিয়ে সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা নির্ধারণ করে ডিএসই। বিএসইসি এ সিদ্ধান্ত বদলে মাত্র ২০ মিনিট কমিয়ে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছে। কমিশনের এমন হস্তক্ষেপের কারণ হিসেবে বলা হয়, লেনদেন সময় কমানো হলে টাকার অঙ্কে লেনদেনও কমে যাবে। আদতে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম রমজানে তাদের বেঁধে দেওয়া সময়ে ডিএসইর লেনদেন ১৯০ কোটি টাকা কমে ৫৬৩ কোটি টাকায় নেমেছে। এদিন ৭৭ শতাংশ শেয়ার দর হারিয়েছে, সূচক হারিয়েছে ৫১ পয়েন্ট।
ডিএসই কর্তৃপক্ষ বলছে, লেনদেন সময় আধা ঘণ্টা এগিয়ে সকাল সাড়ে ৯টা নির্ধারণ করা রোজাদারদের জন্য যেমন সমস্যা হবে, তেমনি ৯টায় অফিস খুলে আধা ঘণ্টার মধ্যে পুরো সিস্টেম চালু করাও চ্যালেঞ্জের। আবার ব্যাংক লেনদেন সময়সীমা শেষ হওয়ার মাত্র ৫০ মিনিট আগে লেনদেন সম্পন্ন হওয়ায় স্পট মার্কেটের লেনদেন নিষ্পত্তি করাতেও বিপত্তির শঙ্কায় আছেন তারা। কর্মকর্তারা জানান, লেনদেন সময় নির্ধারণ শেয়ারবাজারে খুবই ছোট ইস্যু। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এর থেকে অনেক বড় বড় ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করছে। প্রকৃতপক্ষে স্টক এক্সচেঞ্জের হাতে কোনো ক্ষমতাই নেই।
ডিএসইর ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জ এখন ‘পোস্ট অফিস’ ছাড়া কিছুই নয়। ব্রোকারেজ হাউস বা তালিকাভুক্ত কোম্পানির কাছ থেকে অভিন্ন তথ্য নিতে বা দিতে চাইলে স্টক এক্সচেঞ্জকে ব্যবহার করে। অনিয়ম ও কারসাজি প্রতিরোধে যেখানে স্টক এক্সচেঞ্জকে আরও ক্ষমতায়িত করা দরকার, সেখানে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যমান ক্ষমতাই ব্যবহার করতে পারছে না।
জানতে চাইলে ডিএসইর এমডি এটিএম তারিকুজ্জামান বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সময়ে সময়ে পৃথক আদেশ বা নির্দেশ দিয়ে অনেক ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়েছে, এটা সত্য। আইনই কমিশনকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সবসময় এটা প্রয়োগ করলে কার্যকর শেয়ারবাজার গড়ার ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা বলে কিছু থাকে না।
ক্ষমতা কেবল পুস্তকে থাকলে হবে না, তা ব্যবহারে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে– এমন মত ডিএসইর চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাফিজ মো. হাসান বাবুর। তিনি সমকালকে বলেন, “বাইরে থেকে ‘ইনজেকশন পুশ’ করে কিছু করা যাবে না। শেয়ারবাজারের উন্নতি করতে হলে স্টক এক্সচেঞ্জকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। স্টক এক্সচেঞ্জ কেবল ‘পোস্টবক্স’ নয়। আমার যদি বলারই এখতিয়ার না থাকে যে দোকানটি খোলা না বন্ধ, ঠিকমতো চলে কি চলে না, তাহলে আমার কাজটা কী?”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মুখপাত্র রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, কিছু বিষয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে। তবে স্টক এক্সচেঞ্জ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না– এমনটি তাঁর জানা নেই। আইনে থাকার পরও কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হলে তা আইন মেনে এবং প্রয়োজন আছে বলেই দেওয়া হয়েছে। তারপরও ক্ষমতা বাড়াতে সুস্পষ্ট সুপারিশ থাকলে ডিএসই দিতে পারে। কমিশন নিশ্চয়ই তা বিবেচনা করবে।