একটি শ্রেণী কক্ষে যদি ৯৮ ভাগ শিক্ষাত্রী ফেল করে, বলা যেতে পারে শিক্ষক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। আর সেই স্কুলে বা কলেজে যদি প্রতিটি সাবজেক্টেই ৯৮ ভাগ শিক্ষাত্রী ফেল করে, তাহলে বলা যায় সবগুলো শিক্ষকই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। আর এভাবে যদি একযুগেরও বেশি সময় ধরে ৯৮ ভাগ শিক্ষাত্রী প্রতিটি বিষয়ে ফেল করতে থাকে, তাহলে সেই স্কুল কিংবা কলেজের ট্রাস্টি কিংবা পরিচালনা মন্ডলী দায়িত্ব পালনে বার্থ হয়েছেন বলা যায়।
বাংলদেশের শেয়ারবাজারে গত এক যুগের ও বেশি সময় ধরে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর এটি ছিল একটি সামগ্রিক ব্যর্থতা। লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারী তাদের সর্বস্ব হারিয়েছেন এবং অনেকে আত্মহননের পথও বেঁচে নিয়েছেন। তাদের অপরাধ ছিল, তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সঙ্গী হতে চেয়েছিলেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। শেয়ারবাজার নীতি নির্ধারণী মহল থেকে শুরু করে রাষ্ট্র এই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। ২০১০ সালের মার্কেট ক্রাশ করেছিল। এর কারণ অনুসন্ধানে নানা রকম দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। পরবর্তীতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি দীর্ঘ এক যুগ পার হলেও। যার ফলে এই বাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন মরণ ফাঁদ হবে শেয়ারবাজার? প্রথমত, গত কয়েক বছরে যে সব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে, তার বেশির ভাগই দুর্বলমানের কোম্পানি। আর এই দুর্বল কোম্পানির শেয়ার সেকেন্ডারি মার্কেটে এনে প্রথমে ম্যানুপুলেশন করে চড়া দাম হাঁকিয়ে বিনিয়োগকারীদের ঘচিয়ে দেয়া হয় সুকৌশলে। এরপর বাজারে আসার দুই এক বছরের মধ্যে সেগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। আর বিনিয়োগকারীরা সেসব কোম্পানির শেয়ার কিনে সর্বসান্ত হন। এছাড়া আমাদের নীতি নির্ধারণী মহলও বিভিন্ন সময় বিনিয়োগকারীদের নির্ভয়ে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান। কিন্তু যখন বিনিয়োগকারীরা লোকসানে পড়েন, তখন অভয় দেওয়ার জন্য পাশে আর কেউ থাকেন না।
দ্বিতীয়ত, শেয়ারবাজারকে বছরের বেশির ভাগ সময় অস্থির করে রাখা হয় উদ্দেশ প্রণোদিতভাবে । দুর্বল মানের কোম্পানিগুলো ম্যানুপুলেশন করে অধিক মূল্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঘচিয়ে দেয়ার একটা সুগভীর ষড়যন্ত্রে একটি চক্র লিপ্ত থাকলেও এর কোনো বিচার নেই। যার ফলে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীরা এই মার্কেটের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। খালি চোখে আমরা দেখতে পাই শেয়ারগুলোতে বিভিন্ন কারসাজি করা হয়। কিন্তু ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কিংবা বিএসইসির সার্ভিল্যান্স সফটওয়ারে কারসাজি ধরা পড়ে না।
তৃতীয়ত, মার্কেট মেকার এর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ? নানারকম দুর্নীতিতে যুক্ত ছিল ২০১০ থেকে। ২০১০ এর একটি রিপোর্ট এর অংশ বিশেষ-
“Omnibus account: Investigation report found Omnibus accounts of ICB and merchant banks as another major reason behind the stock market debacle. Every branch of merchant bank operates only one omnibus account. There could be 3-10 thousands BO Accounts under the omnibus account which are not under the surveillance of SEC. So, information of individual accounts and its transaction are kept only with merchant banks. As investigation reports shows that this kind of account made a lot of illegal transactions. It publishes name of 30 big players including ICB for a lot of suspicious transactions and says most manipulators traded from the omnibus accounts. It was also reported at least Taka 2.5 billion has been traded from hidden or omnibus accounts.”
মার্কেট মেকার এর কর্ম প্রবাহ পর্যবেক্ষণ এবং দুর্নীতি গ্রস্থ কর্মচারীদের শাস্তির আওতায় না আনলে মার্কেট বার বার মুখ থুবড়ে পড়বে, শেয়ারবাজার আর স্থিতিশীল হবে না।
গত দুই বছরে যে পরিমাণ পলিসিগত সহায়তা দেয়া হয়েছিল, অন্য কোনো দেশ হলে সূচক ১২০০০ পয়েন্টে থাকতো এখন। কিন্তু পলিসিগত সহায়তা দেয়া হলেও বার বার মার্কেটের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, একটি সিন্ডিকেট দেশের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে করে থাকে। কিন্তু কারা করছে গত কয়েক বছরের ডাটা অনুসন্ধান করলে তথ্য বের হয়ে আসবে। রাষ্ট্র এই বিষয়গুলো ঠিকমতো অনুসন্ধান করলে শেয়ারবাজার তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পাবে, আর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বাদ বাকী প্রায় সমস্ত উইংস ভালো পারফর্ম করছে । সব সেক্টর ঠিকঠাক চলছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ন উইং শেয়ারবাজার যেন ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর বিনিয়োগকারীদের জন্য যেন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে শেয়ারবাজার। নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির যেন উর্বর ভূমি এই শেয়ারবাজার। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে এটি কোনো অবস্থায় মেনে নেয়া যায় না। এখনই রাষ্ট্রকে এগিয়ে আশা উচিত আর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে এই মার্কেট কখনোই টেকসই হবে না। বার বার মুখ থুবড়ে পড়বে। রাষ্ট্র যদি এটি করতে আগ্রহী না হয়, তাহলে শেয়ারবাজার নামক এই ক্যান্সার আর প্রতারণার ফাঁদ থেকে লক্ষ লক্ষ বিনিয়োগকারীদের রক্ষার স্বার্থে অর্থনীতি থেকে কেটে বাদ দেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।