পুনঃতফসিল নীতিমালায় শিথিলতা আনার পর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে। ব্যাংকগুলো চাইলে এখন নিজেরাই যেকোনো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারে। এ ছাড়ের কারণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলছে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে পারছে ব্যাংক।
২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টম্বর) ব্যাংক খাতে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে, যা ২০২২ সালের একই সময়ের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
পুনঃতফসিল ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতাকে দায় করেছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের শিথিলতার আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে হলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হতো। এখন তা আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ জমা দিলেই করা যাচ্ছে। আগে এসব ঋণ পরিশোধের সময় ছিল সর্বোচ্চ দুই বছর। এখন ৫ থেকে ৮ বছর সময় পাচ্ছে। এছাড়া আগে বিশেষ সুবিধায় ঋণ নিয়মিত করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগত। এখন সেই ক্ষমতা পুরোটাই ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তাই বোর্ড গ্রাহককে ইচ্ছামতো সুবিধা দিয়ে পুনঃতফসিল করার সুযোগ দিয়েছে। এজন্য ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিকভাবে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) সময়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ১১ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের একই সময়ে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ১৮ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসের তুলনায় ২০২৩ সালের একই সময় পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ৬৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহাবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক মার্কেট সবকিছু সফট হয়ে গেছে। সফট হওয়ার কারণে সবখানের পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে। দেশে রপ্তানির পেমেন্ট ঠিকমতো আসছে না। গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। আবার টেক্সটাইল মেশিনের ইউনিট পরিস্থিতিও খারাপ। সবকিছু মিলিয়ে ব্যবসা পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে। তাই ঋণ নিয়মিত খেলাপি হচ্ছে। খেলাপি ঋণ কম রাখতে ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকের মধ্যে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। পরের প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) পুনঃতফসিল করা হয় ১০ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর পুনঃতফসিল করা হয় ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা।
গত বছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল করেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯ মাসে বেসরকারি ব্যাংক ১৫ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করেছেÑসরকারি ব্যাংক ১ হাজার ৪৩৪ কোটি, বিদেশি ব্যাংক ১০০.২০ কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংক ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বারবার নীতি ছাড়ের কারণে পুনঃতফসিল ঋণ বেড়েছে। এ ছাড় দেয়ার নীতি যতদিন থাকবে ততদিন পুনঃতফসিল ঋণ বাড়বেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এখন ছাড় নীতি বন্ধ করা। এছাড়া যেসব ব্যাংকের পুনঃতফসিল ঋণ বেড়ে যায়, তাদের তিন মাস পর পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখা চাওয়া উচিত। যদি ব্যাখা যথাযথ না হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ১৮ জুলাই পুনঃতফসিল নীতিমালা শিথিল করা হয়। শিথিল করার পর গত ১৫ মাসে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে ৪২ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। শিথিলতার আগের ১৫ মাসে করা হয়েছিল ১৯ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ পুনঃতফসিল বেড়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়ের কারণে কভিডকালে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হতো না। এখন যেহেতু সুবিধা উঠে গেছে, তাই ঋণ খেলাপি না হতে পুনঃতফসিলে ঝুঁকছে। এছাড়া খেলাপি থেকে বের হয়ে নতুন করে ঋণ পাওয়ার জন্য পুনঃতফসিল করছে। তাই অস্বাভাবিকভাবে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ বেড়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালায় শিথিল আনার পর গ্রাহকদের এ সুবিধা বেশি দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কারণ ব্যাংকগুলোর বোর্ডের হাতেই পুরো ক্ষমতা দেয়া আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো অনুমতি নিতে হয় না। যদি ব্যাংকগুলোর বোর্ড ভালো হলে এ সমস্যা হতো না। তখন যাচাই-বাছাই করেই পুনঃতফসিল করত তারা। এখন যেভাবে পুনঃতফসিল করা হচ্ছে, এটা ব্যাংকের জন্য ক্ষতি। এখানে গ্রাহক সুবিধা পাচ্ছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকে আরও কঠোর হওয়া উচিত।
এদিকে পুনঃতফসিল করা ঋণের বিপরীতে গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩০৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। এর আগের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) এর পরিমাণ ছিল ৩৮৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণ ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর তিন মাস আগে জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে নথিপত্রে খেলাপি ঋণ যতই দেখানো হোক না কেন, প্রকৃত চিত্র তার চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। অনেক গ্রুপের ঋণ আদায় না হলেও বছরের পর বছর খেলাপি করা হয় না। আবার একই ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে ঋণ নিয়মিত রাখা হয়।