দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের বেশিরভাগ কোম্পানি ২০১৯-২০ হিসাববছরের লভ্যাংশ ঘোষণার অপেক্ষায় আছে। কোম্পানিগুলোর এ লভ্যাংশের ক্ষেত্রে চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের ব্যবসায়িক অবস্থার বড় প্রভাব থাকবে। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে এই তিন মাসে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে আসে।
এ পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেছে। বিশেষ করে করোনা সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে ব্যবসা করা কিছু কোম্পানির মুনাফায় বড় উল্লম্ফন হয়েছে। ফলে শেয়ারবাজারে কয়েক দিন ধরে গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে, তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি করোনার মধ্যে ভালো ব্যবসা করছে। কোম্পানিগুলো সামনে ভালো লভ্যাংশ দেবে। যার প্রভাবে বেশকিছু ওষুধ ও রসায়ন খাতের প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম বেশ বেড়ে গেছে।
এদিকে তালিকাভুক্ত ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চারটি কোম্পানি লোকসানে রয়েছে। ১৫টি কোম্পানির মুনাফা আগের বছরের তুলানায় কমে গেছে। বিপরীতে ১১টির মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। দুটি কোম্পানি ২০১৯ ও ২০২০ সালের কোনো প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। কোম্পানি দু’টি হলো- কেয়া কসমেটিকস ও লিব্রা ইনফিউশন।
মহামারির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা বাড়ার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন— এই ছয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৫৭ টাকা ৫১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৭ টাকা ২৮ পয়সা।
এছাড়া মুনাফায় বড় উল্লম্ফন হয়েছে আরও এক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশের। এপ্রিল-মার্চ আর্থিক হিসাববছর নির্ধারণ করা কোম্পানিটি চলতি বছরের এপ্রিল-জুনের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩১ টাকা ৬৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৬ টাকা ৯৫ পয়সা।
তাছাড়া ওষুধ ও রসায়ন খাতের অপর বহুজাতিক কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনও মুনাফার দিক থেকে পিছিয়ে নেই। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন— এই ছয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২৬ টাকা ৩৭ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২২ টাকা ২৫ পয়সা। রেকিট বেনকিজারের মতো এই কোম্পানিও আর্থিক হিসাব জানুয়ারি-ডিসেম্বর। সুতরাং সহসা বহুজাতিক এই কোম্পানির সমাপ্ত হিসাববছরে লভ্যাংশ ঘোষণার সম্ভাবনা নেই। তবে অন্তর্বর্তী লভ্যাংশের ঘোষণা আসতে পারে।
এ তিন কোম্পানি বাদে ওষুধ ও রসায়ন খাতের বাকি কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাববছর জুলাই-জুন নির্ধারিত। সেই হিসাবে শিগগিরই প্রতিষ্ঠানগুলোর ২০১৯-২০ হিসাববছরের লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত আসবে।
জুলাই-জুন হিসাববছর নির্ধারণ করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করেছে রেনেটা। এই নয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩৪ টাকা ৫০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৮ টাকা ৫২ পয়সা।
তারপর রয়েছে ফার্মা এইড। ২০১৯-২০ হিসাববছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১৪ টাকা ৩০ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ টাকা ৪৬ পয়সা।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০১৯-২০ হিসাববছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১২ টাকা ৪৪ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১ টাকা ১৫ পয়সা।
এছাড়া নয় মাসের ব্যবসায় আগের বছরের তুলনায় মুনাফা বাড়ার তালিকায় রয়েছে- বেক্সিমকো ফার্মা, ইবনে সিনা, জেএমআই সিরিঞ্জ, ওয়াটা কেমিক্যাল ও ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস।
এদিকে ২০১৯-২০ হিসাববছরের ব্যবসায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে এসিআই। সহযোগী প্রতিষ্ঠানের লোকসান টানতে গিয়ে কোম্পানিটি বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছে। হিসাববছরটির প্রথম নয় মাসের ব্যবসায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্মিলিত লোকসান হয়েছে ১৭ টাকা ৪৯ পয়সা। আগের হিসাববছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৫ টাকা ৫০ পয়সা।
দেখা গেছে,লোকসানের পাশাপাশি কোম্পানিটির সম্পদের মূল্য এবং ক্যাশ ফ্লোতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের মার্চশেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১৩৮ টাকা ৮৭ পয়সা, যা গত বছরের জুনশেষে ছিল ১৬৬ টাকা ৯৮ পয়সা। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৯৫ পয়সা।
তাছাড়া এ নয় মাসের ব্যবসায় এমন করুণ দশা দেখা দিলেও কোম্পানিটির এক কর্মকর্তা জানান, করোনার প্রকোপের মধ্যে চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে স্বপ্ন সুপার সপ ভালো ব্যবসা করেছে। ফলে এই প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান কমে আসতে পারে। কারণ এসিআই যে লোকসান করে তার বড় অংশই স্বপ্নের করণে। তবে আগের তিন প্রান্তিকে কোম্পানিটি যে পরিমাণ লোকসান করেছে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।
এছাড়া এসিআই’র পাশাপাশি লোকসানের খাতায় নাম লেখানোর তালিকায় রয়েছে- সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো সিনথেটিক ও ইমাম বাটন। এর মধ্যে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ব্যবসায় সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালস শেয়ারপ্রতি ১৮ পয়সা লোকসান করেছে। আগের বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৪৪ পয়সা মুনাফা করে।
আরও দেখা গেছে,বেক্সিমকো সিনথেটিক ও ইমাম বাটন লোকসানের পাশাপাশি কোম্পানি দুটির সম্পদের মূল্যও কমেছে। এর মধ্যে বেক্সিমকো সিনথেটিক শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ২ টাকা ৫৩ পয়সা, আগের বছরের একই সময়ে এর শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ২ টাকা ৫৩ পয়সা। লোকসানে নিমজ্জিত কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য ১৪ টাকা ১৩ পয়সা থেকে কমে ১২ টাকা ৯ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
ইমাম বাটনও আগের হিসাববছরে লোকসানে ছিল। ২০১৯-২০ হিসাববছরের প্রথম নয় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২৮ পয়সা, আগের হিসাববছরের একই সময়ে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২২ পয়সা। কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য ৫ টাকা ৩২ পয়সা থেকে কমে ৫ টাকা ৪ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
গত বছরের তুলনায় মুনাফা কমে যাওয়া কোম্পানির তলিকায় রয়েছে- এসিআই ফরমুলেশন, একমি, অ্যাকটিভ ফাইন, অ্যাডভেন্ট ফার্মা, এএফসি অ্যাগ্রো, এমবি ফার্মা, বিকন ফার্মা, ফার কেমিক্যাল, গ্লোবাল হেভি কেমিক্যাল, কোহিনূর কেমিক্যাল, ওরিয়ন ইনফিউশন, ওরিয়ন ফার্মা, সেলভো কেমিক্যাল, সিলভা ফার্মা ও সিলকো ফার্মাসিউটিক্যাল।
ডিএসই’র এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমি যতটুকু বুঝি, করোনার মধ্যে সবগুলো ওষুধ কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেছে— এমন গুঞ্জন সঠিক নয়। তবে কিছু ওষুধ কোম্পানি ভালো করেছে। যা তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সুতরাং বিনিয়োগকারীদের গুজবে কান দিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। কোম্পানিগুলোর আগের প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে। তাহলে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাওয়া যাবে। তার ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘করোনার মধ্যে সব ওষুধ কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেছে, এমন ধারণা সঠিক নয়। কোম্পানিগুলোর আগের নয় মাসের আর্থিক প্রতিবেদন এবং তার আগের বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে বিনিয়োগকারীরা একটা ধারণা পেতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা এটা করেন না। তারা গুজব বা গুঞ্জনের ওপর বিনিয়োগ করেন। এমনটি হলে তো কিছুই করার থাকে না।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ‘করোনার মধ্যে ওষুধ ও রসায়ন খাতের কিছু কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেছে। বিশেষ করে, করোনা সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভালো মুনাফা করেছে। তাই বলে গড়পড়তা সব কোম্পানি ভালো ব্যবসা করেছে— এমন ধারণা কিছুতেই সঠিক হতে পারে না।’
এছাড়া তিনি আরও বলেন, ‘পুঁজিবাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী থাকে, তখন গুজব ছড়ানো সহজ হয়। দীর্ঘদিনের মন্দা কাটিয়ে সম্প্রতি পুঁজিবাজারে ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে কেউ কেউ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে। সুতরাং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। গুজব এড়িয়ে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো করে পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।