পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে গত সপ্তাহে শীর্ষ দরবৃদ্ধির তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। আলোচ্য সময়ে শেয়ারটির দর বেড়েছে ২০ শতাংশের বেশি। শুধু তাই নয়, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও লভ্যাংশ ঘোষণার পর এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম হু-হু করে বাড়তে থাকে। মাত্র ১৩ কার্যদিবসের ব্যবধানে দর বেড়েছে ১৫০ শতাংশের বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো লভ্যাংশের খবরে একটি শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ আট থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তবে ১৫০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পাওয়াকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। তাদের ভাষ্যমতে, আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফা বৃদ্ধির তথ্য এবং লভ্যাংশ ঘোষণাকে পুঁজি করে একটি চক্র বিএসসির শেয়ারে কারসাজি করছে।
দাম কম থাকায় দুই সপ্তাহ আগেও কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। ২৩ ডিসেম্বর বিকালে পর্ষদ সভা শেষে গত হিসাববছরের জন্য ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণার পাশাপাশি চলতি হিসাববছরের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এর পরই শেয়ারটির দর বাড়তে থাকে। পরপর দুই দিন শেয়ারদর বেড়ে সার্কিট ব্রেকার স্পর্শ করে। ৫ জানুয়ারি সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দর ৯৫ টাকা ১০ পয়সায় কেনাবেচা হয়। দরবৃদ্ধির হার প্রায় ১০ শতাংশ।
সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ দরে শেয়ার কেনাবেচার অর্থ হলো, ওই দিন এর থেকে বেশি দরে শেয়ারটি কেনাবেচার সুযোগ নেই। দুপুর ১২টায় লেনদেনের প্রথম দুই ঘণ্টা শেষে এ দরে পৌনে তিন লাখেরও বেশি শেয়ার কেনার জন্য আদেশ ছিল, কিন্তু বিক্রেতার ঘর ছিল শূন্য। অর্থাৎ যাদের কাছে শেয়ার ছিল, তারা আরও বেশি দরে শেয়ার বিক্রির আশা করেছিলেন।
গত ২৩ ডিসেম্বরও বিএসসির শেয়ার ৪৯ টাকা ৪০ পয়সায় কেনাবেচা হয়েছিল। কিন্তু লভ্যাংশ ঘোষণার পরে মাত্র ৯ কার্যদিবসেই শেয়ারটির দর যতটুকু বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব ততটুকু বেড়েছিল। আর ২৩ ডিসেম্বর থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৩ কার্যদিবসের ব্যবধানে দর বেড়েছে ১৫৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এরপর ১২ জানুয়ারি দর কমে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা এবং পরে আবারও দর বেড়ে সর্বশেষ ১২৫ টাকা ৯০ পয়সায় শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের আয় বাড়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কোনো চক্র শেয়ার দাম বাড়াচ্ছে কি না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিএসসির প্রথম প্রান্তিকের আয়কে অনেক বিনিয়োগকারী বার্ষিক আয় মনে করেছে। আবার অনেকে সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে শেয়ার নিয়ে বিভিন্ন কথা লিখছে। এসব কারণে শেয়ারটির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। যদি কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হয়ে থাকে, তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্ত করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, মানুষের চাহিদা পরিবর্তন হয়। কখনও টেক্সটাইল, কখনও ইন্স্যুরেন্স, আবার কখনও ব্যাংক খাতে বিনিয়োগ করে। গত কয়েক দিনে সরকারি শেয়ারগুলোয় আগ্রহ দেখা যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের।
কোনো শেয়ারের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বেড়ে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমন বাজার আমরা চাই না। শেয়ারের দাম স্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাবে, এমনটাই চাই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কোনো কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হলে বিএসইসি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটি জানায়, ২০২১ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে চার টাকা ৩৪ পয়সা। আগের হিসাববছরের একই সময়ে ইপিএসের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৮ পয়সা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছে ৬৪৮ শতাংশ।
অনেকের মতে, মুনাফার হারের এমন তথ্য বিনিয়োগকারীদের এ শেয়ারে আকৃষ্ট করেছে। এছাড়া গত বছর কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশে লকডাউন আরোপের পর সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর পর আবার এ ব্যবস্থা সচল হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাপে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বহুলাংশে বেড়ে যায়। এতে পণ্য পরিবহন খরচও বৃদ্ধি পায়। গত বছর রেকর্ড রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। ফলে শিপিং করপোরেশনের মুনাফা বাড়ছে।
এর আগে, ২০২০ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল বিএসসি। এছাড়া ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছয় শতাংশ এবং ২০১৭ সাল ও ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়। আর ২০১৬ সালে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
ডিএসইর তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ১৫২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা। মোট শেয়ারের সংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৪০টি। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সরকারের কাছে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। এ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের চার ভাগের এক ভাগেরও কম রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।