মহামারি কভিড-১৯-এর আঘাতে চড়া মাশুল দিতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। তবে বছর শেষে মুনাফার সূচকে পরিবর্তন এসেছে। তারল্য সংকট ও কভিডের প্রাদুর্ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবনতির কারণে কমে যাওয়া ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আবার বাড়তে শুরু করেছে। কারণ ২০২১ শেষে কর পূর্ববর্তী মুনাফায় জোয়ার এসেছে বেশিরভাগ ব্যাংকের।
আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে, সেটিই কোনো ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা কোনো ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। এ মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন সংরক্ষণ ও কর-পরবর্তী মুনাফাই হলো একটি ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা।
গত বছর জুন প্রান্তিকে ব্যবসা বাণিজ্যের করুণদশায় কমে আসে পরিচালন মুনাফা। তবে ২০২১ সাল শেষে ফের বাড়ছে কর-পূর্ববর্তী মুনাফা। যেসব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বেড়েছে তার মধ্যে সবার ওপরে ইসলামী ব্যাংক। সদ্যবিদায়ী ২০২১ সালে দুই হাজার ৪৩০ কোটি টাকার মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। তবে আগের বছর ২০২০ সালে তাদের মুনাফা ছিল দুই হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
পূবালী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে এক হাজার ১৪০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ৯৩৫ কোটি টাকা। ২০২১ শেষে বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে মুনাফার পরিমাণ ছিল ৮৭০ কোটি টাকা। এক্সিম ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৭৮০ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল ৭৪১ কোটি টাকা। সদ্য বিদায়ী বছরে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ৬৮০ কোটি টাকা।
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৭১৭ কোটি টাকা। গত বছর এ মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪৫০ কোটি টাকা, যা ২০২০ শেষে ছিল ৩২৩ কোটি টাকা। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক মুনাফা করেছে ২১০ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ১৫২ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১০৫ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল ৭৩ কোটি টাকা। মিডল্যান্ড ব্যাংক মুনাফা করেছে ১৬২ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল ১২৫ কোটি টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৩৭৫ কোটি টাকা, যা ২০২০ সাল শেষে মুনাফা ছিল ৩১৭ কোটি টাকা। এনসিসি ব্যাংক পরিচালন মুনাফা করেছে ৭১৭ কোটি টাকা, ২০২০ সাল শেষে মুনাফা ছিল ৫৭৩ কোটি টাকা। যমুনা ব্যাংক ২০২১ সাল শেষে মুনাফা করেছে ৭৫০ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে ছিল ৬৩৭ কোটি টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা তুলনামূলক কম। আলোচ্য বছর শেষে দেশের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংকের মুনাফা হয়েছে দুই হাজার ২০৭ কোটি টাকা। এক বছর আগে এ মুনাফার পরিমাণ ছিল দুই হাজার ১৫৪ কোটি। অন্যদিকে রূপালী ব্যাংকের মুনাফা ১৫০ কোটি, এক বছর আগে যা ছিল ১৫৯ কোটি টাকা। মুনাফা কমার তালিকায় রয়েছে বছরজুড়ে আলোচিত ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ২০২১ সালে ২৪৮ কোটি টাকা মুনাফা করে ন্যাশনাল ব্যাংক। তবে এক বছর আগে এ মুনাফা ছিল ৯২০ কোটি টাকা।
কভিডের কারণে ২০২০ সালে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে গিয়েছিল। গত বছর আবার বেড়ে যায়। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, কভিডের কারণে ২০২০ সালে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় কভিডের ধাক্কা লাগে। এতে মুনাফা কমে যায়। এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ ছাড়ের কারণে পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকের আদায় কমেছে। কিছু ব্যাংক কৌশলে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় পরিচালন মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিন্মে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।